কল্যাণ ডেস্ক
মানসিব চৌধুরী সম্প্রতি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বিয়েতে মোট ৮০০ জনকে দাওয়াত করলেও মেহমান এসেছিলেন ৫০০ জনের মতো।
প্লেটের বেচে যাওয়া খাবার থেকে শুরু করে বড় বড় অনুষ্ঠানে ডেকচি ডেকচি খাবারের হিসাব করলে দেখা যায়, শুধু বাংলাদেশেই একজন মানুষ বাৎসরিক গড়ে ৬৫ কেজি খাদ্য অপচয় করে।
বৈশ্বিক খাদ্য অপচয়ের চালচিত্র দেখলে রীতিমতো আঁতকে উঠতে হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএওর সর্বশেষ হিসাব থেকে দেখা যায়, প্রতিবছর বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ খাবার অপচয় হয়, যা ওজনের হিসাবে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন টনের বেশি এবং অর্থমূল্যের হিসাবে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি।
জাতিসংঘের ১৭টি টেকশই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) মধ্যে একটি খাদ্যের অপচয় রোধ করা। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার ১২ দশমিক ৩ অনুচ্ছেদে আছে ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্যের অপচয় অর্ধেকে নামিয়ে আনা।
তবে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউনেপের সর্বশেষ ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্সের হিসাব থেকে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত বিশ্বে যে পরিমাণে খাবার অপচয় হয় তা সমগ্র গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের ৮ থেকে ১০ শতাংশ।
ইউনেপের এই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে বছরে ১ কোটি টনের বেশি খাদ্য অপচয় হয়। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি খাদ্য অপচয় হয় চীনে। বছরে দেশটিতে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টনের মতো খাদ্য অপচয় হয়।
এই যখন খাদ্য অপচয়ের চিত্র; বিপরীতে ক্ষুধার চিত্র আরও মারাত্মক। উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশনের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন বিশ্বে ৮২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়, যা মোট বৈশ্বিক জনসংখ্যার ১০ শতাংশ।
অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাঙালি অমর্ত্য সেন তার দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্য বইয়ের শুরুতেই লিখেছেন, বিশ্বে কখনো খাদ্য সংকটের কারণে দুর্ভিক্ষ হয়নি, দুর্ভিক্ষ হয়েছে খাদ্য সরবরাহে ব্যাঘাতের কারণে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিশ্বের ৫৮ দেশের ২৫৮ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং দিনকে দিন এ সংখ্যা বাড়ছে। যেভাবে বৈশ্বিক সংঘাত, জলবায়ু সংকট ও অর্থনৈতিক স্থবরিতা দিনকে দিন বাড়ছে তাতে করে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আগামী দিনগুলোতে আরও প্রকট রূপ ধারণ করবে।
বাংলাদেশে খাদ্য অপচয় প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক খালেদা ইসলাম বলেন, বিশ্বে একদিকে মানুষ ক্ষুধা পেটে ঘুমাতে যাচ্ছে, অন্যদিকে আবার দেদারছে খাদ্য অপচয় করছে আরেক শ্রেণির মানুষ। এই বৈষম্য কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব দেশে পাউরুটি প্রধান খাদ্য সেসব দেশে স্যান্ডুইচ বানাতে যে পরিমাণে ব্রেড ক্রাঞ্চ অপচয় করা হয়, শুধু সেই ফেলে দেয়া খাদ্য থেকে কয়েক কোটি মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করা সম্ভব।
খালেদা বলেন, চা খেয়ে কাপে কিছুটা রেখে যাওয়া কিংবা প্লেটে ইচ্ছা করে খাবার রেখে যাওয়াকে অনেকে ভদ্রতা বলে গণ্য করেন। উচ্চশ্রেণি বা সেলিব্রেটি সম্প্রদায়ের মধ্যে খাদ্য নষ্ট করার এ ধরনের উদাহরণ মানুষের মধ্য অনুকরণীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু যত যাই করা হোক না কেন, ভদ্রতার মেকি সংস্কৃতির নামে খাদ্য অপচয় কখনোই মেনে নেয়া যায় না।
খাদ্য অপচয় রুখতে ব্যাপক প্রচারণার প্রয়োজন আছে উল্লেখ করে খালেদা বলেন, বর্তমানে অনেক রেস্টুরেন্টে পোস্টার বা সাইনবোর্ড টানিয়ে খাদ্য অপচয় না করার জন্য অনুরোধ করা হয়। এটি আরও ব্যাপকভাবে করতে হবে। খাদ্য অপচয়কে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেয়া উচিত না।
গবেষণা সংস্থা আইএফসিওর প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বে অপচয় হওয়া খাদ্যের মধ্যে ৪৫ শতাংশ ফলমূল এবং সবজি, ৩৫ শতাংশ মাছ, ৩০ শতাংশ শস্য, ২০ শতাংশ দুগ্ধজাত পণ্য এবং ২০ শতাংশ মাংসজাত পণ্য। মূলত এসব খাদ্যপণ্য অপচয় উৎপাদন থেকে শুরু করে ভক্ষণ প্রতিটি পর্যায়ে হয়ে থাকে। পর্যায়ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ বাড়াতে পারলে খাদ্য অপচয় কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া অপচয় রোধের পাশাপাশি সুষ্ঠু বণ্টনের দিকে জোর দেয়া হয় জাতিসংঘসহ নানা সংস্থার প্রতিবেদনে।