নাজমুন নাহার রিনু: চাবির গোছাটি আমার। ক্ষমতাও আমার। ক্ষমতা প্রয়োগ করতে আমিই একমাত্র পারি।
এমন ভাবনা পরিবারে সর্বদা বিরাজমান। পরিবারে অর্থ্যাৎ সংসারের চাবির গোছাটি বর্তমানে আমার আছে, ভবিষ্যতেও আমার থাকবে। এমন ধ্যান ধারণা নিয়ে পরিবারের মধ্যে জটিলতা দেখা যায়। সরাসরি বলতে এই চাবির গোছা নিয়ে বউ, শাশুড়ির ঝগড়া বাধে নিরন্তর। একটি মেয়ের বিয়ের পর স্বামীর সংসারে আসে। নতুন বৌকে নিজের মেয়ের মত ভাবতে পারে না অধিকাংশ শাশুড়ি। শাশুড়িরা মনে করেন আমার সংসারের চাবির গোছা মনে হয় হস্তান্তর হবে এবার। আরো মনে করেন আমার কোনো ক্ষমতা থাকবে না। ছেলে মনে হয় এখন বউয়ের কথামত চলবে। শাশুড়িরা নতুন বউয়ের সাথে দূরত্ব বজায় রাখেন। অধিকাংশ সময় বউমাকে আদেশ নির্দেশমূলক কথা বলেন। ভালোবেসে মধুর স্বরে ডাকলে যতই সহজে আপন করা যায়। হুকুমের স্বরে কথা বললে কাজটি তত কঠিন হয়। অধিকাংশ শাশুড়িরা মনে করেন আমি উঠতে বললে বউ মা উঠবে বসতে বললে বসবে। বাড়ির সবকিছু আমার কথায় চলবে। এ মানসিকতার জন্য বাড়ির বউরা শাশুড়িদের প্রতি অখুশি থাকে। বাড়ির বউ-শাশুড়ির বিভিন্ন মন্দ ভাব মূর্তি দেখে তারাও সংসারের জটিলতা সৃষ্টি করে। বাড়ির চাবি আমার তাই ক্ষমতাও আমার। এই সংসারের ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য এভাবে শুরু হয় অশান্তি।
অনেক সময় বউরাও নতুন সংসারে এসে, নিজের মত সংসারকে সাজাতে চায়। সংসারটির আমার সকল দায়িত্বও আমার। সকল ক্ষমতাও আমার। সংসারের চাবির গোছাও আমার। এই আমার আমার করতে করতে বউদের মানুষিকতাও এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, শশুড়বাড়ির মানুষদের আপন ভাবতে পারে না। সংসারে দেখা দেয় জটিলতা। যা প্রতিনিয়ত অশান্তুিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
পরিবারের মধ্যে প্রকাশ্য ঝগড়া আবার গোপনীয়ভাবে সংসারের রাজনীতি চলতে থাকে। ছোট খাটো বিষয় নিয়ে অশান্তি শুরু হয়। যার ফলে বাড়ির ছেলেদের বিপাকে পড়তে হয়। অনেক ছেলে মায়ের পক্ষ নেয়। আবার অনেক ছেলে বউ এর পক্ষ নিয়ে থাকে। যারা মায়ের পক্ষ সব সময় নিয়ে থাকে তারা অধিকাংশ সময় বউয়ের উপর শারীরিক নির্যাতন করে। বউকে কোনো কথা বলার সুযোগ দেয় না। সব কিছু না বুঝে না শুনে অমানসিক নির্যাতন করে। বউ যদি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হয় তাহলে অবহেলা, নির্যাতনের মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। অনেক সময় নির্যাতন এমন পর্যায়ে যায়, বউ অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে বউটি ধীরে ধীরে রোগ ব্যাধিতে ভুগতে থাকে। আবার অনেক সময় মৃত্যুও বরণ করে। এমন অনেক ঘটনাও আমরা জানি।
তবে বলবো যে সবকিছুর জন্য একমাত্র কারণ হলো চাবির গোছা। সংসারে আধিপত্য বিস্তার, ক্ষমতার প্রয়োগ। সংসার আমার সম্পদও আমার। সবকিছু আমার কথায় চলবে । এমন ভাবনার কারণে আমাদের পরিবারে সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। শাশুড়ি বউদের মধ্যে বন্ধুত্ব সম্পর্ক তৈরি হয় না। কেননা প্রথম থেকে দুজনই দুরত্ব বজায় রেখে চলে। আপন করে নেয়ার মানসিকতার মধ্যে একটা ফাঁক থেকে যায় প্রায়। বউ ও শাশুড়ি মনে করে থাকে সবকিছু আমিই করতে পারি। বা আমিই করবো। বউকে প্রশংসা যদি কেউ করে তাহলে শাশুড়ির সহ্য হয় না আবার শাশুড়িকে কেউ প্রশংসা করলে বাড়ির বউ ও রাগ হয়ে থাকে। আমাকে সবাই প্রশংসা করুক। এমন ভাবনা শুরু থেকে তাদের থেকে যায়। এজন্য অনেক সংসার ভেঙে যায়। স্বাধী -স্ত্রী ডিভোর্স হয়ে যায়।
সাহিত্যিক টরিয়ানো বলেছেন ‘সংসারে স্বামীরা বধির আর স্ত্রীরা যদি অন্ধ হয় তাহলে সংসারে অশান্তি থাকে না।’
সত্যিই তাই, স্বামীরা যদি বধির হয় কোনো কিছু শুনেও না শোনার ভান করেন তাহলে সংসারে অশান্তি হয় না। বউরা দেখেও না দেখার ভান করেন তাহলে অবশ্যই সংসারে অশান্তি হয় না।
সকলের সাথে প্রথম থেকে নতুন বউ যদি মিলেমিশে থাকতে পারে। সকলকে আপন করে নিতে পারে। তাহলে পরিবারের অশান্তিটা থাকে না। শাশুড়িরাও যদি নতুন বউকে নিজের মেয়ের মত দেখতে পারে। আবার এমন হয় যে, বউমাকে যদি বোঝাতে পারে যে, সংসারটা তার, পরিবারটাও তার, বাড়ি ঘর, ধন সম্পত্তি সব কিছু তার, তার সন্তানদের এবং ঘর সংসার, সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও তার। তাহলে সংসারের জটিলতা থাকে না বা সৃষ্টি হয় না।
কিন্তু দেখা যায় শাশুড়ি বর্তমানে যেমন আধিপত্য বিস্তার করে থাকেন সংসারে। সংসার হাতের মুঠোই রাখতে চান। হুকুম জারি, শাসন শোষণ করে থাকেন, ভবিষ্যতে একদিন বউ শাশুড়ি হয় তখন সেও তার বাড়ির বউ এর উপর সাথে এমন হুকুম, শাসন ও আধিপত্যের কাজ করতে থাকে। সংসার পরিক্রমা এভাবে এগিয়ে চলছে।
বিখ্যাত মনীষী গোল্ড স্মিথ বলেছেন ‘সংসারে যে সকলকে আপন ভাবতে পারে, সে অবশ্যই সুখী হয়।’
ভালো মন্দ নিয়ে আমাদের সংসার। সকলকে নিয়ে আমাদের ভাল থাকার চেষ্টা করা উচিত। তাহলে মনের প্রশান্তি আসবে। দূর হবে সকল দুঃখ-কষ্ট। ফিরে পাবো শান্তির আবাস ভূমি।