প্রায় এক মাস আগে যশোরে জরুরি মতবিনিময় করে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেয় সংগঠনটি
নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোর জেলা ও ৮ উপজেলা বিএনপি প্রায় এক মাস আগে জরুরি মতবিনিময় সভা করে দখলদারি, চাঁদাবাজি, মারামারি, শালিস বৈঠক, সর্বপরি অনিয়মের বিরুদ্ধে নেতাকর্মীদের ‘চূড়ান্ত’ সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু এরপরও জেলার বিভিন্ন স্থানে অনিয়ম-অবৈধ কাজে লিপ্ত রয়েছেন কিছু কিছু নেতাকর্মী। সর্বশেষ যশোর সদর উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও চাঁচড়ার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা এবং ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সহসভাপতি আব্দুল হালিম সালিশের নামে মালেকা বেগম নামে এক নারীর বাড়ি ভাংচুর করেছে। জেলা বিএনপি শনিবার তাদের বহিস্কারও করেছে।
বারবার হুঁশিয়ারি দিয়েও নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না দলটি। এমন ‘উচ্ছৃঙ্খল’ নেতাকর্মীদের নিয়ে এখন বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। তাদের কর্মকাণ্ড দলটির জন্য এখন গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে।
এসব ঘটনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির শীর্ষ নেতারা ক্ষুব্ধ এবং বিব্রত।
সূত্র মতে, গত ১৬ মার্চ পৌর কমিউনিটি সেন্টারে যশোর জেলা বিএনপির জরুরি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ মার্চ যশোর সদর উপজেলা, ১৮ মার্চ ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির জরুরি মতবিনিময় সভা করে। কাছাকাছি সময়ে জেলার ৮ উপজেলাতেই জরুরি মতবিনিময় সভা করা হয়। এতে উপজেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ ছাড়াও ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন। তাদের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাসেজ দেন দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ।
শালিস বিচার করতে নিষেধ করা হয়েছে। টিসিবি, ভিজিডিসহ অন্যান্য কার্ড নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা কোন অনিয়মে জড়ালে রক্ষা নেই। তাদের বহিষ্কার করা হবে। ব্যক্তির দায় দল নেবে না।
—– অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, সভাপতি, যশোর জেলা বিএনপি
সূত্রের দাবি, গত ৫ আগস্টের পর সারা দেশের মতো যশোর জেলায় টিসিবি, ভিজিডি কার্ড, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল নিয়ে অনিয়মে লিপ্ত হন বিএনপির নেতাকর্মীদের অনেকে। টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, নিজেদের মধ্যে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন কেউ কেউ। প্রায়ই এসব খবরে বিরক্ত ও বিব্রত হন জেলার দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ। সেসব অনিয়মের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে কড়া অবস্থানও নিতে দেখা যায়। বহিষ্কার করা হয় পদধারীদের। এমনকি বহিষ্কৃতদের সাথে নেতাকর্মীদের যোগাযোগ না রাখতেও আহ্বান জানাতে দেখা গেছে। দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখা বা সংগঠনের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে এমন কড়াকড়ি করতে বাধ্য হন নেতৃত্ব। এরপরও নিয়ন্ত্রণে আসছিলেন না অনেকেই। এ অবস্থায় জরুরি মতবিনিময় সভা করে জেলা ও ৮ উপজেলা বিএনপি।
ওই সব মিটিংয়ে উপস্থিত কয়েক নেতা জানিয়েছেন, মিটিংয়ের পর থেকে আর যেন কোন অভিযোগ শোনা না যায় এজন্য দল চূড়ান্ত কড়া বার্তা দিয়েছে। কারণ নির্বাচনের আগে ব্যক্তির দায়ে দল ক্ষতিগ্রস্ত ও বদনামের ভাগিদার হচ্ছে। এতে জনগণ যেমন ভুল বুঝছে, তেমনি আসন্ন নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে চলা জামায়াত ইসলামী এর সুফল ঘরে তুলতে পারে।
এদিকে, এমন কড়া হুঁশিয়ারির পরও নানা অঘটনের জন্ম দিচ্ছে মাঠে পর্যায়ের বিএনপির নেতারা। সর্বশেষ ‘গত ১৭ এপ্রিল ভোররাতে যশোর সদর উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি গোলাম মোস্তফা ও ওয়ার্ড বিএনপি নেতা আব্দুল হালিম একটি রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে সালিশ বসান। এরপর তারা করিচিয়া গ্রামের উত্তরপাড়ার মালেকা বেগম নামে এক নারীর সেমিপাকা বাড়ি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি জানার পর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাদের দুজনকে দল থেকে পূর্ণাঙ্গ রূপে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
এরআগে গত ১৯ মার্চ বেনাপোল পোর্টে শ্রমিকদের একটি মিছিলকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। মিছিলে বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য মফিকুল হাসান তৃপ্তির বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এতে শার্শা উপজেলা বিএনপির শ্রমবিষয়ক সম্পাদক শহীদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায়। ওই ঘটনায় শহীদ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন বলে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয় জেলা বিএনপি।
এদিকে, ১২ এপ্রিল শার্শার উলাশী ইউনিয়নে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয়পক্ষের ৫ জন আহত হন।
যুবদলের নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করছিলেন যশোর শহরের হুঁশতলার অনিক। এর বিরুদ্ধে নগর যুবদল বিবৃতি দিয়ে বলেছে, অনিক যুবদলের কেউ নয়। দখল-চাঁদাবাজির অভিযোগে গত ১০ এপ্রিল বহিষ্কার করা হয়েছে শার্শার লক্ষণপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আহসান হাবিব খোকনকে। একই দিন বহিষ্কার হয়েছেন চৌগাছা ছাত্রদলের জসিম উদ্দিন ও মোবারক হোসেন। উপজেলা ছাত্রদলের সদস্যসচিব ইমন হাসানকে মারধরের অভিযোগে তাদের দুইজনের বহিষ্কার করা হয়।
অন্যদিকে, গত ২৩ মার্চ শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যশোরের মণিরামপুর, কেশবপুর উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের বিএনপির ৪ নেতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মণিরামপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম ও চালুয়াটি ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের দলীয় পদ স্থগিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। একই অপরাধে দুই মাসের জন্য কেশবপুর পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুজ্জামান চৌধুরীর সদস্যপদ স্থগিত ও কেশবপুর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি রেজাউল ইসলামকে চূড়ান্ত সতর্ক করা হয়।
জরুরি মতবিনিময়ের পরও এভাবে অপরাধ-অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, আমরা দলের মধ্যে বিভাজন-দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করছি। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন এলাকার নেতাকর্মীদের নিয়ে বসছি।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, টিসিবি, ভিজিডিসহ অন্যান্য কার্ড নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা কোন অনিয়মে জড়ালে রক্ষা নেই। তাদের বহিষ্কার করা হবে। ব্যক্তির দায় দল নেবে না।
এদিকে, কেন্দ্রীয় দফতর সূত্র জানা গেছে, গত সাত মাসে বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের তিন হাজার ২০০ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপিরই এক হাজার ৮০০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এদের অন্তত ৭০০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ, ৮০০ জনকে বহিষ্কার, ৫০ জনের পদ স্থগিত, অন্তত ১০০ জনকে সতর্ক এবং ১৫০ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেয়া হয়েছে। সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও এ পর্যন্ত ৪০০ জনকে বহিষ্কার ও ৬০০-এর অধিক নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছে। অঙ্গসংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তত ১০০ জনকে বহিষ্কার ও ১৫০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়েছে। যুবদলেরও শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।