নিজস্ব প্রতিবেদক
মারপিট করে কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে লায়লাতুন জান্নাত নামে যশোরের চৌগাছার এক গৃহবধূকে। তদন্ত শেষে সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম এমনই তথ্য জানিয়েছেন। এই মামলায় নিহতের স্বামী এনামুল কবীর ইসমাইল ও তার ভাই, পিতা-মাতাসহ ৫ জনকে অভিযুক্ত এবং আরো তিনজনের অব্যাহতি চেয়ে যশোর আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য ২০২১ সালের ৩০এপ্রিল চৌগাছা উপজেলার স্বরূপদাহ ইউনিয়নের তিলকপুর গ্রামে নিহতের স্বামী এনামুল কবীর ইসমাইলের বাড়িতে লায়লাতুন জান্নাতের মৃত্যু হয়।
মৃত লায়লা নড়াইল শহরের মহিষখোলা এলাকার অ্যাডভোকেট শেখ থায়েব আলী আসাদের একমাত্র মেয়ে।
অভিযুক্তরা হলেন, চৌগাছা উপজেলার তিলকপুর গ্রামের একছের আলী মন্ডল, তার স্ত্রী জুলেখা বেগম, তিন ছেলে এনামুল কবীর ইসমাইল, হাচান আলী ও তানভীর আহম্মেদ বকুল।
এই মামলা থেখে অব্যাহতি চাওয়া হয়েছে, এনামুল কবীর ইসমাইলের বোন তারা বেগম ও তার ভাই বকুল মন্ডলের স্ত্রী মণি বেগমকে।
মামলার বিবরণে জানা গেছে, ২০০৫ সালের পারিবারিকভাবে এনামুল কবীর ইসমাইলের সাথে লায়লাতুন জান্নাতের বিয়ে হয়। দাম্পত্য জীবনে ইশরাক হোসেন ও ইশান হোসেন নামে দুইটি ছেলের জন্ম হয়েছে তাদের। ২০১২ সালে ইসমাইল ঢাকার হেমায়েতপুরে জমি ক্রয় করতে টাকার প্রয়োজন হওয়ায় লায়লার কাছে যৌতুক দাবি করেন। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় লায়লার উপর অমানসিক নির্যাতন শুরু করে ইসমাইল। শুধু তাই নয়, লায়লাকে মারপিটের পরে তার পিতার বাড়ি নড়াইলে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনায় লায়লার পিতা অ্যাডভোকেট শেখ তায়েব আলী আসাদ নড়াইল সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। এরই মধ্যে ওই মামলা থেকে রেহাই পেতে ইসমাইল যৌতুক ছাড়াই স্ত্রী লায়লাকে নিয়ে সংসার করবেন বলে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে মৌখিকভাবে অঙ্গীকার করেন। এরপর আবারও লায়লাকে নিয়ে সংসার করার মধ্যে জমি ক্রয়ের জন্য টাকা দাবি করেন। বাধ্য হয়ে লায়লার পিতা জামাই ইসমাইলকে নগদ দুই লাখ টাকা এবং স্বর্ণালংকার ক্রয় করা বাবদে আরো তিন লাখসহ মোট ৫ লাখ টাকা দেন। কিছুদিন পর আবারও দুই লাখ টাকা যৌতুক দাবিতে লায়লাকে মারপিট শুরু করে। কিন্তু ওই সময় লায়লার পিতা গুরুতর অসুস্থ থাকায় ভারতে ওপেনহার্ট সার্জারি করেন। ফলে টাকা না দেয়ায় অন্যত্র আরেকটি বিয়ে করে যৌতুক আদায়ের কথা বলে এক নারীর সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন ইসমাইল। বাধা দেয়ায় ২০২১ সালের ২৩ এপ্রিল সকালে ইসমাইল, তার আরো দুই ভাই, বোন, মা ও বাবাসহ পরিবারের সকালের লায়লাকে মারপিট করেন। বিষয়টি মোবাইল ফোনে লায়লা তার পিতাকে জানান। ওই সময় লায়লার ছোট থেকে মাত্র আড়াই মাস বয়স। যে কারণে মারপিটের শিকার হয়েও তিনি সেখানেই ছিলেন। পাশাপাশি এই ঘটনায় কোন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় আবারও পরিবারের সকলে মিয়ে লায়লাকে মারপিট করে। এরপরে তার মুখে জোর করে কীটনাশক ঢেলে দিয়ে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়া হয়। কিছুক্ষণ পরই লায়লাকে তারা প্রথমে চৌগাছা উপজেলা স্বাক্ষ্য কমপ্লেক্সে, পরে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় ঢাকায় রেফার করে চিকিৎসকেরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেটে পৌছানো মাত্র লায়লা মারা যান।
কিন্তু এতকিছুর পরও বিষয়টি লায়লার পিতার পরিবারকে জানাননি ইসমাইলের পরিবার। শুধু তাই নয়, লায়লা লাশ দাফনেরও চেষ্টা করে। লোক মারফত খবর পেয়ে চৌগাছা থানা থেকে পুলিশ নিয়ে লায়লার লাশ উদ্ধার করে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। ময়না তদন্ত শেষে নড়াইলে দাফনের সময়ও ইসমাইলের পরিবার কোন খোঁজখবর নেননি।
এরপরে লায়লার ঘাতক স্বামী ও তার পরিবারের মোট সাতজনের বিরুদ্ধে চৌগাছা থানায় মামলা করেন তার পিতা। পুলিশ ওইদিনই লায়লার ঘাতক স্বামী ইসমাইলসহ দুইজনকে আটক করে। কয়েকমাস হাজতবাসের পর আদালতে থেকে ইসমাইলের জামিন হয়।
মামলাটি প্রথমে চৌগাছা থানার এসআই গিয়াস উদ্দিন তদন্ত করেন। এসআই গিয়াস উদ্দিনের তদন্তে গাফিলাতির অভিযোগে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)’র এসআই রেজওয়ান তদন্ত করেন। এসআই রেজওয়ান তদন্তকালে আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ঘটনাটি ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা করেন। ফলে তিনি শুধুমাত্র ইসমাইলকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।
ওই তদন্তের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেন বাদী অ্যাডভোকেট শেখ তায়েব আলী আসাদ। আদালতের নির্দেশে সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক সুব্রত পাল তদন্ত করেন। তিনিও একই পথে পা রাখেন। ফলে বাদীর অভিযোগের ভিত্তিতে সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মানিক চন্দ্র গাইন তদন্ত করেন। কিন্তু তার অন্যত্র বদলী হওয়ায় পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম তদন্ত করেন। সিরাজুল ইসলাম ওই মামলায় ৫জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।
মামলার বাদী অ্যাডভোকেট শেখ তায়েব আলী এই তদন্তে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, তার একমাত্র মেয়ে লায়লাতুন জান্নাত হত্যার বিচার দাবি করেন।