নিজস্ব প্রতিবেদক
ইসির ঘোষণা অনুযায়ী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনও প্রায় চার মাস বাকি। তবে বেশ আগে থেকেই যশোর-৪ আসনে নির্বাচনী হওয়া জোরেশোরেই বইছে। এ আসনে গণসংযোগে রয়েছেন বর্তমানে তিনটি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। এর মধ্যে জামায়াতে ইসরামীর একজন, ইসলামী আন্দোলনের একজন ও বিএনপির তিনজন। জামায়াতে ইসলামীর যশোর জেলা আমীর গোলাম রসুল ও ইসলামী আন্দোলনের এ্যাড. মাওলানা বায়েজিদ হোসেন এ আসনে প্রার্থী মনোনীত হয়েছেন বেশ আগেই। বিএনপি এখনও অফিসিয়ালি মনোনয়ন ঘোষণা করেনি। তবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সবুজ সংকেত পেয়েছেন দাবি করে কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য টিএস আইয়ুব বেশ জোরালোভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিএনপির অপর দুই মনোনয়ন প্রত্যাশী হচ্ছেন অভয়নগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মতিয়ার রহমান ফারাজি ও কেন্দ্রীয় যুবদল নেতা নুরে আলম সিদ্দিকী সোহাগ।
বাঘারপাড়া ও অভয়নগর উপজেলার সাথে সদরের বসুন্দিয়া ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত যশোর-৪ আসন। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে সংসদীয় এলাকা পরিবর্তন হয়। বাঘারপাড়ার সাথে সদরের পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠন হয় সংসদীয় এলাকা। ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে আবার সংসদীয় এলাকা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। গত ১২ টি নির্বাচনে আটবার জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী। এর মধ্যে ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে প্রয়াত শাহ হাদিউজ্জামান, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে রণজিত রায়। সর্বশেষ ২০২৪ এর নির্বাচনে এনামুল হক বাবুল নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে বিএনপি মনোনীত ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে জয় পান নাজিম উদ্দীন আল আজাদ। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে এ্যাড. নজরুল ইসলাম ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জোটের জাতীয় পার্টির (নাফি) এমএম আমীন উদ্দীন নির্বাাচিত হন।
আগামী নির্বাচনে এ আসনের সব থেকে আলোচিত প্রার্থী হচ্ছেন প্রকৌশলী টিএস আইয়ুব। তিনি কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও কেন্দ্রীয় কৃষক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ১৯৯৯ সালে কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সদস্য পদ নিয়ে তার যাত্রা শুরু হয় বিএনপির রাজনীতিতে। ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে তিনি বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। গত ১৭ অক্টোবর রাতে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সবুজ সংকেত পেয়েছেন দাবি করে নেতাকর্মীদের মাঝে মিষ্টি বিতরণও করেছেন। পরদিন ১৮ অক্টোবর বাঘারপাড়ার উপজেলা সদরে গণ সমাবেশে করে তিনি তার চূড়ান্ত মনোনয়নের কথা ঘোষণা দেন। বাঘারপাড়ায় বিএনপির রাজনীতিতে দ্বিধা বিভক্তি রয়েছে। পকেট কমিটি, দলের ভেতর স্বেচ্ছাচারিতা ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ এনে টিএস আইয়ুবের বিপক্ষে শক্ত গ্রুপিং এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক দুই উপজেলা চেয়ারম্যান মসিয়ুর রহমান, আবু তাহের সিদ্দিকী, সাবেক মেয়র ও পৌর বিএনপির সভাপতি আব্দুল হাই মণা, উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বিল্লাল হোসেন। তারাও বিভিন্ন সময়ে পাল্টা কর্মসূচির মাধ্যমে টিএস আইয়ুব বাদে অন্য কোন বিকল্প প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন। তাদের দাবি টিএস আইয়ুব কয়েকটি ব্যাংকে মোট দেড়শ কোটি টাকার উপরে ঋণ খেলাপি হয়েছেন। প্রতিটি ব্যাংক তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছে। এর মধ্যে একটি ব্যাংকের ঋণ মামলার রায়ও হয়েছে। এছাড়াও ঢাকা ব্যাংকে জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিং এর অপরাধে দুদকের দেওয়া মামলার বিচার কাজ চলমান রয়েছে। সব কিছু মিলে টিএস আইয়ুবের প্রতিপক্ষের দাবি দল থাকে মনোনয়ন দিলেও তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না। যাচাই বাছাইয়ে ঋণের দায়ে তার প্রার্থীতা বাতিল হবে। একটি সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ দলীয় হাই কমান্ডের কয়েকজন নেতার কাছে টিএস আইয়ুবের বিপক্ষে অভয়নগরের এক বিএনপি নেতা অভিযোগ দাখিল করেছেন। অভিযোগের সাথে ঋন খেলাপির তথ্যাদি ও মামলার কপিও দিয়েছেন। তবে টিএস আইয়ুবের দাবি তিনি তার সমস্ত ঋণ রেগুলার করে ফেলেছেন। ফলে তার প্রার্থীতা বাতিল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
বিএনপির আরেক শক্তিশালী মনোনয়ন প্রত্যাশী হচ্ছেন অভয়নগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় শ্রমীক দলের সিনিয়র সহ সভাপতি মতিয়ার রহমান ফারাজি। তিনি কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্যও ছিলেন। অভয়নগর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনও করেছেন দীর্ঘদিন। বিএনপির জন্মলগ্ন থেকেই তিনি এ দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি যে তিনজনকে মনোনয়ন দিয়েছিলো তার মধ্যে মতিয়ার রহমান ফারাজির নাম ছিলো দ্বিতীয় অবস্থানে। এ কারণে তিনি ও তার অনুসারিরা এবার আশাবাদি। অভয়নগরে রয়েছে তার শক্ত অবস্থান। বাঘারপাড়ার এক অংশও তার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এ উপলক্ষে গত শুক্রবার অভয়নগর থেকে দুই সহাস্রাধিক মোটর সাইকেলের শোভাযাত্রা নিয়ে বাঘারপাড়ার এক জনসমাবেশে যোগ দেন মতিয়ার রহমান ফারাজি। এ কারণে যশোর চার আসনের রাজনীতিতে নতুন এক মেরুকরণের সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের সহকারি এ্যাটর্নি জেনারেল নুরে আলম সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজনীতিতে আলোচনায় আসেন। তিনি বর্তমান ঢাকা দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক। এর আগে তিনি কেন্দ্রীয় যুব দলের সহ আইন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। জুলাই আন্দোলনে তিনি যুব দলের ঢাকা মহানগরে প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। এ কারণে কেন্দ্রীয় বিএনপির নিকট তিনি আস্থাভাজন ও পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন। ঢাকা হাইকোর্ট অঙ্গনে বিভিন্ন সময়ের আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। এক বছরের অধিক সময় ধরে তিনি বাঘারপাড়া ও অভয়নগরে গণ সংযোগ করছেন।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ৮ অক্টোবর কেন্দ্রীয় বিএনপি এ আসনের তিনজন মনোনয়ন প্রত্যাশীকে সাক্ষাতকারে ডাকেন। টিএস আইয়ুব, মতিয়ার রহমান ফারাজি ও নূরে আলম সিদ্দিকী সোহাগকে। কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের এক সাথে কাজ করার নির্দেশ দেন। মাঠ পর্যায়ে সে নির্দেশ কেউই মানছেন না। একে অপরকে বিষাদগার করছেন। যে কারণে ২৭ অক্টোবর বাঘারপাড়ার তিনজন ও অভয়নগরের একজনকে কেন্দ্রীয় বিএনপির গুলশান অফিসে সাক্ষাতকারে ডেকেছেন। ডাকপ্রাপ্তরা হচ্ছেন বাঘারপাড়া পৌর বিএনপির সভাপতি ও সাবেক মেয়র আব্দুল হাই মনা। বাঘারপাড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবু তাহের সিদ্দিকী। বাঘারপাড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মসিয়ুর রহমান ও অভয়নগর উপজেলা বিএনপি নেতা মশিয়ার রহমান মশি।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সব কিছু মিলে যশোর-৪ আসনে বিএনপির রাজনীতি অনেকটা জগাখিচুড়িতে রূপ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ও যশোর জেলা বিএনপি তিন মনোনয়ন প্রত্যাশীকে এক সাথে কাজ করার কথা বললেও কেউই তা মানছেন না।
বাংলাদেশ জামায়েতে ইসলামী এ আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছেন অনেক আগেই। যশোর জেলা জামায়াতের আমীর গোলাম রসুল এ আসনের প্রার্থী হিসাবে গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন। ৫ আগস্টের পর থেকে জামায়াতের নানা ভূমিকার কারণে এক শ্রেণির সাধারণ মানুষ এ সংগঠনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। একারণে বিগত দিনের তুলনায় এ আসনে জামায়াতের বেশ শক্ত অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে। গোলাম রসুলের বাড়ি বাঘারপাড়া উপজেলা সংলগ্ন পাইকপাড়া গ্রামে। আশির দশকের প্রথম দিকে বাঘারপাড়ায় ছাত্র জীবনে তিনি শিবিরের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। যশোরের হামিদপুর আল হেরা ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতার সুবাদে শহরেই বাস করেন। সংগঠনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পর তিনি জেলা জামায়াতের আমীরের দায়িত্ব পেয়েছেন। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে তিনি এ সংসদীয় এলাকায় ব্যাপক হারে গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন।
ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনও এ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। এ দলের ঘোষিত প্রার্থীর নাম এ্যাড. মাওলানা বায়েজীদ হোসাইন। আইন পেশায় কাজ করেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করা বায়েজিদ হোসাইন ইসলামী আইনজীবী পরিষদের জয়েন্ট সেক্রেটারি জেনারেলের পদে রয়েছেন। পাশাপাশি তিনি ইসলামী যুব আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় আইন ও মানবাধিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। আইন পেশার ফাঁকে ফাঁকে এলাকায় তিনি তার কর্মী সমার্থকদের নিয়ে গণসংযোগ করছেন।
কোন গণসংযোগ ছাড়াই কিছু বিল বোর্ড টানিয়েই হঠাৎ আলোচনায় উঠে এসেছেন সাবেক এমপি এম এম আমীন উদ্দীনের ছেলে আশিকুর রহমান মিঠু। ২০০১ সালের নির্বাচনে মহাজোটের শরীক দল বিজেপি নেতা এম এম আমীন উদ্দীন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এ আসনে এমপি নির্বাচিত হন। এবারও বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ যে ৩/৪ টি আসনের জন্য বিএনপির কাছে দাবি জানিয়েছেন তার মধ্যে যশোর-৪ আসন অন্যতম। এ কারণে অনেকের ধারণা বিএনপির কোন্দলের কারণে ২০০১ এর মত এবারও হয়তো তেমন একটা কিছু ঘটে যেতে পারে।
অভয়নগর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী গোলাম হায়দার ডাবলু গত শনিবার এক সমাবেশে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসাবে নিজেকে ঘোষনা দিয়েছেন। বাঘারপাড়া পৌর বিএনপির সভাপতি ও সাবেক মেয়র আব্দুল হাই মনা, বাঘারপাড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মসিয়ুর রহমান ও অভয়নগর উপজেলা বিএনপি নেতা মশিয়ার রহমান মশিও সুযোগ পেলে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। তবে তারা কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও গণসংযোগ শুরু করেননি।
