রেজওয়ান বাপ্পী
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯। বিকেল সাড়ে ৩টা। বরিশালের গৌরনদী এলাকা। একটি লরির সঙ্গে সংঘর্ষ। হয়ে যান পঙ্গু। সেই থেকে দীর্ঘ ছয় বছর ধরে হাঁটা-চলা করতে পারেন না। একটির পর একটি অপারেশনে খুইয়েছেন অন্তত ১২ লাখ টাকা। তবে শ্রমিক সংগঠন কিংবা সরকার খোঁজ নেয়নি। বলছি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার কলাগাছি গ্রামের শফিকুল ইসলামের কথা। শুধু শফিকুল ইসলামই নয়, এ গ্রামের লাল্টু হোসেন, ইব্রাহিম হোসেন, রনি হোসেনসহ একাধিক চালক-হেলপারও দুর্ঘটনায় পতিত হন। কেউ হাঁটা-চলা করেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কেউবা মেরুদণ্ডের তীব্র ব্যাথা নিয়ে কর্মজীবন পার করছেন।
শফিকুল ইসলাম বলেন, অভাবের সংসার ছিল। অন্তত ৫ বছর হেলপারি করার পর স্টিংয়ারিং ধরার সুযোগ পাই। আশা ছিল সংসারের অভাব ঘোচাবো। তবে ২০১৯ সালে বরিশালের গৌরনদী এলাকা থেকে বাড়ির দিকে ফিরছিলাম। সেখানে একটি লরির সঙ্গে সংঘর্ষে আমি পঙ্গু হয়ে যাই। সেই থেকে বাড়িতে পড়ে আছি। পা ভালো হবে এই আশায় ছয় বছরে ৮-১০ বার অপারেশন করেছি। এতে খরচ হয়েছে ১০-১২ লাখ টাকা।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, শ্রমিক ইউনিয়নে আমার কার্ডের বয়স ২৫ বছর। প্রতি বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণে চাঁদা দিয়ে রিনিউ করা। লাইসেন্সের বয়সও তেমন। তবে এ পর্যন্ত শ্রমিক সংগঠন অথবা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা আমি পাইনি। একাধিকবার যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হয়েছি। এক সপ্তাহ আগেও আবার অপারেশন করতে হয়েছে। এবারও লাখ খানিক টাকা খরচ হচ্ছে। তবে একতা হাসপাতালের ডাক্তার হারুণ অর রশিদের সহযোগিতা তিনি পাচ্ছেন বলে জানান।
তিনি বলেন, প্রথমে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় আমার চিকিৎসা শুরু হয়। পরে বন্ধু-বান্ধবরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের সহযোগিতায় আমি কোনোমতে চিকিৎসারটা চালিয়ে যাচ্ছি। সংসার চলছে কিভাবে; এমন প্রশ্নে শফিকুল বলেন, আমার দুই মেয়ে। তারা স্কুলে লেখাপড়া করে। স্ত্রী সামান্য মজুরির কাজ করে। তাতেই খেয়ে না খেয়ে পার হচ্ছে।
ট্রাক ড্রাইভার লাল্টু হোসেন বলেন, ২০১৩ সালের দিকে দুর্ঘটনায় পতিত হই। আমার দুটি পা ভেঙে যায়। এখনও দুই পায়ে তিনটি রড রয়েছে। এ পর্যন্ত আমার ১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তবে কারো কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি।
গত তিন মাস আগে কুমিল্লায় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বাড়িতে পড়ে থাকা নাভারণ কলোনি এলাকার ভ্যানচালক রফিকের ছেলে মো. হাসান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আমার পেটের নাড়ি ছিড়ে যায়। এ পর্যন্ত চারলাখ টাকা খরচ হয়েছে। কেউ সহযোগিতা করেনি। তিনি আরও বলেন, ঝিকরগাছা থেকে যশাের জেলা ট্রাক ও ট্যাংকলরি ট্রাক্টর ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে আমাকে দেখে গেছে। পরে তারা সহযোগিতার ব্যাপারে আর যোগাযোগ করেনি।
উপজেলার নির্বাসখোলার সাদীপুর গ্রামের ট্রাকচালক জসিম উদ্দিন বলেন, গত চারমাস ধরে কোটালিপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় আমার একটি পা ভেঙে বাড়িতে পড়ে আছি। পায়ে রিং লাগানো রয়েছে। এ পর্যন্ত লাখ খানিক টাকা আমার খরচ হয়েছে। তবে শ্রমিক ইউনিয়ন বা সরকারি কোনো দপ্তর থেকে সাহায্য পাইনি।
যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কে পঞ্চাশ বছর ধরে বাসের কন্ট্রাকটারি করা স্বপন হোসেন বলেন, ‘নাবালক বয়সে টেনিয়া মামুর হাত ধরে বাসের হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করি। এখন কন্ট্রাকটারি করি। এ জগতের সবাই আমাকে চিনে। ৫০ বছরেও পরিবারের স্বচ্ছলতা আনতে পারিনি। শুধু আমি নয় এ লাইনের কেউ ভালো নেই। যার উপায় নেই সে এই লাইনে আসে। তবে এখন অনেকে পেশা পরিবর্তন করছে।
আয়ের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতি ট্রিপে একজন ড্রাইভার ১ হাজার ও একজন কন্ট্রাকটার ১ হাজার টাকা পায়। হেলপার পায় ৫০০-৬০০ টাকা। প্রতি মাসে এভারেজে ২০টি ট্রিপ হয়। এতে যে টাকা আয় হয় সে টাকা রোডেই ব্যয় হয়ে যায়।
গত ৫ আগস্টের পর থেকে যশোর জেলা ট্রাক ও ট্যাংকলরি ট্রাক্টর ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দেওয়া শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘যারা অসুস্থ অবস্থায় পড়ে আছে তাদের বিষয়টি আমার নলেজে আছে। ইতোমধ্যে তাদেরকে আমি দেখতে গিয়েছি। তাদের কার্ড রিনিউ করে দিয়েছি। সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়ে তিনি বলেন, তারা আমার সদস্য। তাদেরকে আমি কি সাহায্য করছি সেটা তাদের সঙ্গে আলোচনা করবো। আপনি তো আমার সদস্য না, আপনার সঙ্গে কেনো বলবো?’ সংগঠনের কতজন সদস্য এ রকম অসহায় অবস্থায় আছে জানতে চাইলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে ফোন কেটে দেন।
যশোর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি বিশ্বনাথ ঘোষ বিষু বলেন, জেলায় মোট ৫০-৭০ হাজার শ্রমিক আছেন। বিভিন্ন নামে ৯টি শ্রমিক ইউনিয়ন রয়েছে। একেকজন শ্রমিক একেক ইউনিয়নের সদস্য। আমার ইউনিয়নে সদস্য আছে ২৫৬১ জন। ২২৭নং ইউনিয়নের সদস্য রয়েছে ৯ হাজার, গাড়িখানায় আছে ৬ হাজার।
তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নের সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছেন ৩-৪ জন। অসুস্থ আছেন ৬-৭ জন। অন্ধত্ববরণ করেছেন দুজন। এ দুজনকে আমরা অবসর দিয়েছি। তাদেরকে অবসর দেওয়ার সময় এককালীন ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের ৪৬২নং ইউনিয়নের নিয়ম অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ট্রিটমেন্ট চলাকালীন মালিকপক্ষের কাছ থেকে অনুদান পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি আমরা কিছু সহযোগিতা করে তাকে সুস্থ করে তুলি।
বিষু জানান, গত ২৩ আগস্ট তারা ৯ জন সদস্যকে অবসর দিয়েছেন। এরমধ্যে ড্রাইভার ৫০ হাজার, কন্ট্রাকটর ৫৮ হাজার ও হেলপারকে ৫৫ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। গত তিন বছরে তারা মৃত্যুকালীন ৫৪ সদস্যের পরিবারকে মাথাপিছু ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। এছাড়া দুর্ঘটনার বাইরে কোনো শ্রমিক যদি অসুস্থ হয় তাহলে যশোর সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে তার সকল প্রকার ওষুধ কিনে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। যদি উন্নত চিকিৎসার জন্য যশোরের বাইরে যেতে হয় তাহলে তাকে এককালীন ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) যশোর সার্কেলের সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম ওয়াজেদ হোসেন জানান, গত সেপ্টেম্বর মাসে যশোর জেলায় ১০টি দুর্ঘটনায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৩ জন। গত আগস্ট মাসেও এ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত হয়েছেন।
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত আমরা ১৯টি আহত-নিহত পরিবারকে ৮১ লাখ টাকা আর্থিক সহযোগিতা করেছি। অনেকেই টাকা পাননি; এমন প্রশ্নে ওয়াজেদ হোসেন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার এক মাসের মধ্যে আমাদের কাছে আবেদন করতে হবে। অন্যথায় তিনি আর্থিক সহযোগিতা পাবেন না।
