মো. আনোয়ার হোসেন বিপুল: ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা সাড়ে সাত কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার কৃষক শ্রমিক ছাত্রসহ সর্বস্তরের মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তাক্ত লড়াইয়ের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনেন লাল-সবুজের পতাকা। এই সংগ্রামে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা শীতলক্ষ্যা ব্রহ্মপুত্রের জল রক্তে লাল হয়েছে। সম্মান হারানো দু’লাখ মা-বোনের বোবা কান্না আর বেদনার প্রভাব রয়েছে সবুজের বুকে লাল বৃত্তে।
সেই স্বাধীন দেশের নাগরিক আমরা। এমন সংগ্রাম, আত্মত্যাগ আর রক্তে রঞ্জিতের ঘটনা, ইতিহাসে কমই আছে। দেশে দেশে স্বাধীনতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, অধিকাংশ ঘটনায় যতটা না সাধারণ মানুষের সম্পর্ক আছে, তার চেয়ে আছে আন্ত:দেশিয় রাজনীতি। যেমন- সেভিয়েত রাশিয়া ভেঙে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। কিন্তু এসব স্বাধীন দেশের পিছনে সেসব দেশের সাধারণ মানুষের যতটা অংশগ্রহণ ছিল তার থেকে আমেরিকা ও রাশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধ কাজ করেছে বেশি। সময়ের পরিক্রমায় ব্রিটিশ সা¤্রাজ্য থেকে বহু দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেসব ক্ষেত্রেও রক্তাক্ত লড়াইয়ের ইতিহাস কম। আর আমরা, আমাদের পূর্বপুরুষেরা রণাঙ্গনে রক্তের বন্যা বইয়ে এনেছি স্বাধীনতা। তাই আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের সার্বভৌমত্বের মানে ভিন্ন। এদেশের লাল-সবুজ পতাকা উত্থিত হয়েছে রক্ত গঙ্গার বিনিময়ে। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের পতাকা মানেই দেশপ্রেম দেশপ্রেম এবং দেশপ্রেম।
আজ এমন এক সময় এই লেখাটা লিখছি যখন অর্থনৈতিক মানদণ্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ গত এক যুগে এগিয়ে গেছে অনেক। সেটা পাটিগণিতের হিসেবে নয়, রীতিমতো জ্যামিতিক হারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশ-বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বাংলাদেশের উন্নতির গ্রাফ বিবেচনা করে সেদেশে প্রয়োগের চেষ্টা করছে। যাকে বলা হচ্ছে ‘শেখ হাসিনার উন্নয়ন মডেল’।
কিন্তু এত এগিয়ে যাওয়া সত্বেও বাংলাদেশ ঝুঁকিতে নেই তা কিন্তু নয়! একটি দেশ কতটা উন্নয়ন হবে, কতটা বিশ্বের বুকে নিজের স্বতন্ত্রতা দাবী করবে, কতটা স্বাধীন সার্বভৌমত্ব অধিকার ভোগ করবে তা নির্ভর করে সেই দেশে মানুষের দেশপ্রেমের উপর। আর ধ্রুপদী রাজনৈতিক সাহিত্য বলছে, মানুষের সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে জন্ম নেয় দেশপ্রেম। অর্থাৎ সামাজিক দায়বদ্ধতার বৃহত্তর পরিসর হচ্ছে দেশপ্রেম। কিন্তু এদেশের একটা বড় অংশ মানুষের আত্মকেন্দ্রিক তৎপরতা সামাজিক দায়বদ্ধতা ভুলিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ বড়লোক হওয়ার লোভে জড়িয়ে পড়ছে দুর্নীতিতে। অনায়াসে চালিয়ে যাচ্ছে সামাজিকব্যাধি মাদক ব্যবসা। এজন্য একাত্তরের দেশপ্রেমের বিবেচনায় আজকের দেশপ্রেমের রংটা অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। আজ খোদ দেশপ্রেমই রীতিমতো প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
একপক্ষ দেশপ্রেমের বয়ান দিয়ে রীতিমতো অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ কামনা করছে বারংবার। সেই পক্ষের সাথে বরাবরের মত কথিত একটি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় যুক্ত হয়েছেন। যারা মূলত এনজিও ব্যবসায়ী। আবার অপর একটি পক্ষ এমন আত্মকেন্দ্রিক তৎপরতার সাথে যুক্ত যারা সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি বেমালুম ভুলতে বসেছে।
এমন বাস্তবতায় এবারের স্বাধীনতা দিবসে আমাদের নতুন করে শপথ নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কারণ জাতির পিতার আদর্শ বাস্তবায়ন করতে তার ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নাগরিকদের মধ্যে একাত্তরের চেতনা ধারণ করা জরুরি। এজন্য সবার আগে দরকার সামাজিক দায়বদ্ধতা আর দেশপ্রেম।
লেখক ঃ যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান।