নিজস্ব প্রতিবেদক
শিক্ষকতার পাশাপাশি স্কুল পরিচালনা করার দায়িত্ব তার কাঁধে। তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। কিন্তু তিনিই রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায়। বলছি যশোরের ঝিকরগাছার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ সরকারি এমএল মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান আজাদের কথা। তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এরই মধ্যে গড়িয়েছে জেলা প্রশাসক পর্যন্ত। গঠন হয়েছে তদন্ত কমিটি।
অভিযোগ রয়েছে, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বৈরাচারী আচরণ, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের টিফিন, পরীক্ষার ফিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে বরাদ্দকৃত ৭৮ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন তিনি।
জানা গেছে, ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন অভিভাবক মাশকুরা খাতুন। শুধু তাই নয়, তার অপসারণ দাবিতে ফুঁসে উঠেছে শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে মানববন্ধন, বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে তারা।
গত ৯ আগস্ট অভিভাবক মাশকুরা অভিযোগে বলেন, পরীক্ষার ফি এবং বোর্ডের নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত নিবন্ধন ফি বিনা রশিদের মাধ্যমে আদায় করছিলেন প্রধান শিক্ষক। পরে ইউএনও বরাবর অভিযোগ করলে অতিরিক্ত আদায় করা টাকা ফেরত দেন তিনি।
এ বিষয়ের জের ধরে অভিভাবক ও সাবেক শিক্ষার্থীরা প্রধান শিক্ষকের কাছে প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাব চান। সন্তোষজনক জবাব না পেয়ে চার শিক্ষকের সমন্বয়ে আর্থিক খাত নিরীক্ষার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত স্কুলের আয়-ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ যাচাই-বাছাই করা হয়। এ সময় ৩১টি খাতে ৭৮ লাখ ৬৫ হাজার ৪৮৭ টাকার আর্থিক অসঙ্গতি পায় নিরীক্ষা কমিটি।
নিরীক্ষায় উঠে এসেছে, আম্ফান ঝড়ে বিদ্যালয়কে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও তার কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। ২০২৪ সালে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে স্কুলের সামনের রাস্তা ও টয়লেট নির্মাণ বাবদ ২০ লাখ টাকা অনুমোদন দেয়া হলেও সিডিউল অনুযায়ী কাজ হয়নি। স্কুলটি সরকারি হলেও ৬ষ্ঠ, ৭ম, ৮ম শ্রেণিতে মাসিক বেতন ১১০ টাকা হারে এবং ৯ম ও ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসিক বেতন ১২০ টাকা হারে আদায় করেছেন প্রধান শিক্ষক।
নিরীক্ষা কমিটির প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, বিদ্যালয় ম্যাগাজিন তৈরির নামে স্কুলের ব্যাংক একাউন্ট থেকে ৪৩ হাজার ১৩৫ টাকা তুললেও তা খরচ না করে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৩০০ টাকা করে আদায় করে ৩৯ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। টিফিন বাবদ ব্যাংক থেকে ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৬৯৩ টাকা উত্তোলন করলেও তার থেকে ২ লাখ ৬৩ হাজার ৩৮১ টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। ভর্তি বাবদ আদায় আদায় করা ৮ হাজার টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী সরকারি বেতনভুক্ত হলেও প্রধান শিক্ষক তার বেতন বাবদ ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৪০ টাকা তুলে নিয়েছেন। কমনরুম বানানোর জন্য ২৩ হাজার ৭৯৩ টাকা উঠালেও বিদ্যালয়ে কোনো কমনরুম নেই। মুদ্রণ খাতে ব্যয়ের জন্য ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা তোলা হলেও সেখান থেকে ৫০ হাজার টাকার ঘাপলা করা হয়েছে। বিবিধ খাতে খরচ মর্মে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৩৮৫ টাকা তোলা হলেও সেখানে ১ লাখ ৩ হাজার ৪০ টাকা নয়ছয়ের তথ্য পেয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটি।
এছাড়া ৭০ টাকা টিফিন বাবদ আদায় করলেও টিফিন সরবরাহ করা হয় না। খাতওয়ারি টাকা আদায় করা হলেও বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং নবীনবরণ অনুষ্ঠান হয় না বলে জানা গেছে।
বিষয়টি আচ করতে পেরে ১৮ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন প্রধান শিক্ষক আজাদ। শুধু এই নয় পরে তিনি ২০ আগস্ট থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি মেডিকেল ছুটি নেন। বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে ২২ আগস্ট বিদ্যালয়ের গেট বন্ধ করে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা।
এদিকে মাশকুরার অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলামের নির্দেশে উপজেলার প্রাণিসম্পদ অফিসার মাসুমা আখতারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
অপরদিকে, ২০২১-২২ অর্থবছরে অবকাঠামো উন্নয়নখাতে একটি প্রকল্প কাগজে-কলমে সমাপ্ত দেখিয়ে বরাদ্দকৃত সমুদয় টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। তবে বিষয়টি জানাজানি হলে ওই প্রকল্পের কাজ এখন তড়িঘড়ি করে শুরু করা হয়েছে।
অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান আজাদ তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ষড়যন্ত্রমূলক বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ভুলত্রুটি সবার থাকে। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে সত্য প্রকাশ পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।