যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক
♦ পাঁচ বছরে নিহত ১২, আহত অসংখ্য
♦ গাছ পড়ে পাশের ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি
♦ গাছ ও ডালপালা হেলে এসেছে রাস্তায়
♦ বিপদ হাতে করে গাড়ি চালান চালকরা
♦ পক্ষ-বিপক্ষ থাকায় অপসারণে জটিলতা
এম আর মাসুদ, ঝিকরগাছা
যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের শতবর্ষী ঝুঁকিপূর্ণ ও মৃত গাছ আবার বিপদ ডেকে এনেছে। এবার পুরানো গাছের ডাল ভেঙে বাসের ছাদে পড়ে সালাউদ্দিন (৪৫) ও শিমুল হোসেন (৩৫) নামে দুই যাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে মহাসড়কের বেনেয়ালী ব্র্যাক কার্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে গত পাঁচ বছরে গাছ পড়ে, মরা, শুকনা ও হেলে পড়া গাছে দুর্ঘটনায় অন্তত ১২ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটলো। এছাড়া বিভিন্ন সময় গাছ পড়ে পাশের ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
যশোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত যাওয়ার ঐতিহাসিক এই সড়ক ‘যশোর রোড’ নামে পরিচিত। এর দুই পাশে এখনো টিকে থাকা গাছগুলো অপসারণ ও রক্ষা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। এজন্য গাছগুলো অপসরণ করা যায়নি। ফলে মহাসড়কটির দুই ধারে ঝুঁকিপূর্ণ ও মৃত রেইট্রি গাছ বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রায় দুর্ঘটনা ঘটলেও কিছুই করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। এজন্য প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছেই।
নাভারণ হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বেনাপোল থেকে যশোরগামী একটি কাভার্ডভ্যান যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের বেনেয়ালি ব্র্যাক অফিসের সামনে পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাসকে সাইড দিতে গিয়ে সড়কের পাশের গাছে ধাক্কা দেয়। এতে গাছের ওপরের একটি ডাল ভেঙে বাসের ছাদের ওপর পড়ে। তখন বাসের ছাদে থাকা দুই ব্যক্তি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে নিচে পড়ে যান। এ সময় সালাউদ্দিন নামে একজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। গুরুতর আহত হন শিমুল হোসেন নামের আরও একজন। তাকে ঝিকরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। সালাউদ্দিন যশোরের উপশহরের বি ব্লকের ও শিমুল হোসেন বেনাপোল বড় আঁচড়া গ্রামের বাসিন্দা।
এদিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, মহাসড়ক ঘেঁষে হেলে থাকা ওই গাছের বড়ো ডালটির সাথে যানবহনের ধাক্কা লেগে ভেঙে চিকন হয়ে গেছে। এতে করে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় ডালটি ভেঙে প্রাণহানি ঘটে। স্থানীয় শেখ হেলাল জানান, রাতে যশোরগামী একটি কাভার্ডভ্যান গাছে ধাক্কা দিলে একটি বড় শুকনো ডাল ভেঙে বেনাপোলগামী যাত্রীবাহী বাসের উপর পড়ে। তখন বাসের ছাদে থাকা তিনজন পড়ে যান। এর মধ্যে দুইজন বাসের পেছনের চাকায় পিষ্ট হন। অপরজন ছিটকে সড়কের পাশে পড়ায় বেঁচে যান।
এদিকে এ নিয়ে এই সড়কে গত পাঁচ বছরে গাছ পড়ে, মরা, শুকনা ও হেলে পড়া গাছে দুর্ঘটনায় অন্তত ১২ জনের প্রাণহানি হলো। বিষয়টি নিয়ে ১০ জানুয়ারি দৈনিক কল্যাণে ‘প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে শতবর্ষী গাছ’ শিরোনামে একটি সচিত্র সংবাদও প্রকাশিত হয়। সংবাদে উল্লেখ করা হয়, ঝিকরগাছার মল্লিকপুর ধেভড়িপাড়া থেকে নাভারণ পুরাতন বাজার পর্যন্ত অন্তত শতবর্ষী ১৫টি বড়ো শিশুগাছ মহাসড়কের মাঝখান পর্যন্ত হেলে থাকায় বড় কাভার্ডভ্যান ও পরিবহন চলাচল করতে পারছে না। এর মধ্যে মল্লিকপুর ধেভড়িপাড়া, কীত্তিপুর পালপাড়া, হাজিরালী মহিলা কলেজ মোড়, বালিখোলা, বেনেয়ালী, গদখালী ফুল বাজার, নবীবনগর মোড়, কলাগাছি, নাভারণ কলোনী পাড়া এবং নাভারণ পুরাতন বাজার এলাকায় সড়কের উপরে গাছ হেলে রয়েছে। এসব স্থানে আরও ২০টি মরা গাছের নিচ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে মানুষ ও যানবাহন চলাচল করছে। এছাড়া ঝিকরগাছা বাসস্ট্যান্ড মসজিদের সামনে পেছনে মরা গাছ থাকায় ঝুঁকি রয়েছে। উপজেলার বেনেয়ালী গির্জার সামনে মহাসড়কের দুইপাশে ৫টি গাছ এমনভাবে হেলে রয়েছে যে কোনো বাস-ট্রাক চলার সময়ে সড়কের একপাশ দিয়ে যেতে পারে না। আর বড়ো কাভার্ডভ্যান ও পরিবহনগুলো সড়কের মাঝখান দিয়ে চলাচল করা ছাড়া উপায় নেই। এখানকার হেলে থাকা গাছগুলোর অর্ধেকই ভেঙে পড়েছে যানবাহনের সাথে ধাক্কা খেয়ে। গত তিন বছরে শুধু এখানে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ জন। গির্জার সামনের এলাকায় সড়কের দুইপাশের শতবর্ষী শিশুগাছগুলো হেলে গেটের মত হয়ে রয়েছে। এতে কোনো যানবাহন তার নির্দিষ্ট পাশ দিয়ে চলাচল করতে না পারায় বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। বিশেষ করে গাছে বেধে যাওয়ার আশংকায় যখন বিপরীত পাশে গাড়ি চাপিয়ে দেয় তখনই মোটরসাইকেলসহ ছোট গাড়িগুলো নিচে পড়ে।
এদিকে গাছগুলো অপসারণ করার জন্য স্থানীয় জনগণ এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। সর্বশেষ দুইজন নিহত হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারা অতি দ্রুত এই গাছগুলো অপসারণ করে যশোর বেনাপোল মহাসড়ক ৬ লেনে উন্নীতকরণের দাবি জানিয়েছেন।
ইসরাফিল হোসাইন নামে এক বাস চালক বলেন, উপরে গাছের ডাল আর নিচে গাছের গোড়া সড়কের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বামপাশ দিয়ে চলার কথা থাকলেও গাছে বেধে যাওয়ায় আশংকায় রং সাইডে ঢুকে পড়া লাগে। তখন যদি সামনের দিক থেকে গাড়ি আসে তাহলে বিপদে পড়তে হয়। খুব ঝুঁকি নিয়ে এ মহাসড়কে গাড়ি চালাই। সব সময় মনে হয় কখন কি হয়!
এ প্রসঙ্গে ভারত বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, যাদের বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে গাছগুলো কাটা গেলো না এবং রাস্তার মাঝে গাছ থাকার কারণে এখন হরহামেশাই মানুষ মারা যাচ্ছে; সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর উচিৎ তাদের নামে হত্যা মামলা করা।
ঝিকরগাছা ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (জেডিও) নির্বাহী পরিচালক মনিরুজ্জামান মনির বলেন, মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ গাছগুলো কাটার জন্য পাঁচ বছর ধরে গণস্বাক্ষর, মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করাসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছি। আমরা দ্রুত এর সমাধান চাই। আমরা ঝুঁকিমুক্ত মহাসড়ক চাই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুল হক বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি এবং জেলা প্রশাসককে জানিয়েছি। মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ গাছগুলোর বিষয়ে জেলার সব মাসিক সমন্বয় সভায় উঠানো হয়। গাছগুলো জেলা পরিষদের সম্পদ। তারাও গাছগুলো কাটার প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন, কিন্তু আদালতে গাছ কাটার বিষয়ে মামলা থাকায় বিলম্ব হচ্ছে।