শাহারুল ইসলাম ফারদিন
রোববার দুপুর ২টা। যশোর শহরের ব্যস্ততম এলাকা জজকোর্ট মোড়ে রাস্তার ধারে গাছের ছায়ায় ভ্যানে ডাব বিক্রি করছিলেন দুই ব্যবসায়ী। এ সময় জিয়া নামের এক ডাব ব্যবসায়ীকে এক ক্রেতা এসেই দুইটি ডাব কেটে ব্যাগে দিতে বলেন। ডাব ব্যাগে নেওয়ার পর দাম শুনে অবাক হয়ে যান ক্রেতা। বড় সাইজের ডাবের দাম চাওয়া হয় ১৩০ টাকা। এবার ব্যবসায়ী ও ওই ক্রেতার মধ্যে শুরু হয় বাগযুদ্ধ।
ক্রেতা রাশেদুল ইসলাম বলেন, আমি শহরেরই বাসিন্দা। হঠাৎ করেই তীব্র গরমে পাতলা পায়খানা হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম ডাবের দাম ৮০ টাকা হবে। ১৩০ টাকা পিস ডাব! কি বলবো ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। বাধ্য হয়ে একটা ডাব নিলাম। দুটো ডাব কেনার মতো অবস্থা নেই।
ডাব বিক্রেতা জিয়া বলেন, ঈদের আগে ডাবের এতো চাহিদা ছিল না। ঈদের পর গরম অনেক বেশি। তাই ডাবের চাহিদাও বেড়েছে। ১শ টাকার উপরে ডাব কিনতেই হচ্ছে। এ কারণে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমার কাছে তিন কোয়ালিটির ডাব আছে। ১৪০ টাকা, ১৩০ টাকা ও ১১০ টাকা দরে সেগুলো বিক্রি করছি।
আরেক ডাব বিক্রেতা তছলিম হোসেন বলেন, বড় ডাব তিনি ১৫০ টাকা পিস, মাঝারিটা ১৩০-১৪০ টাকা আর ছোটটা ১১০-১২০ টাকা দামে বিক্রি করছেন।
যশোরে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শহরের ডাবেও যেন লেগে গেছে আগুন! ১০০ টাকার নিচে মিলছে না কোন ডাব। তীব্র এ গরমে জনজীবনে হাঁসফাস অবস্থা। যশোর বিমানবন্দর আবহাওয়া অফিসের তথ্য, তাপমাত্রা আরও এক সপ্তাহ এমন থাকতে পারে। ফলে জনজীবনে বাড়তে পারে অস্বস্তি। এ পরিস্থিতিতে চাহিদা বাড়ছে ডাব ও তরমুজসহ অন্যান্য রসালো ফলের। আর সেই সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে এসব ফলের দামও।
রোববার শহরের হাসপাতাল মোড়, চৌরাস্তা, মনিহার এলাকা, পালবাড়ি মোড়, কোর্ট চত্বরসহ শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ছোট সাইজের প্রতি পিস ডাব বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। আর মাঝারি ও বড় সাইজের ডাবের জন্য গুনতে হচ্ছে ১১০ থেকে ১৪০ টাকা পর্যন্ত। বিক্রেতারা জানান, তীব্র গরমে বেড়ে গেছে ডাবের চাহিদা। তাই সরবরাহ থাকার পরও দাম বাড়ছে।
যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, ডাবে প্রচুর পটাশিয়াম থাকে, যা এ তীব্র গরমে যেকোনো ডায়রিয়া বা বমিজনিত কিংবা যেকোনো পানি স্বল্পতায় খুবই উপকারী। তাই রোগীদের সবসময়ই ডাব খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে প্রতি পিস ডাবের দাম ১৪০ টাকার কাছাকাছি। এতে অনেক রোগীই প্রয়োজন অনুযায়ী ডাব খেতে পারছেন না বলে জানান তিনি।
শহরের হাসপাতাল মোড় এলাকার ডাব বিক্রেতা আজিজুল ইসলাম জানান, বাজারে ডাবের কোনো সংকট নেই। তবে সরবরাহের তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি। তাই দামও কিছুটা বেড়েছে। ডাবের সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, তীব্র গরমে চাহিদা মেটাতে গাছ থেকে ছোট ছোট ডাব এখন পেড়ে ফেলা হচ্ছে। এতে গরম না কমলে সামনে ডাবের সংকট দেখা দিতে পারে। ফলে দাম আরও বাড়তে পারে। আড়ত পর্যায়ে ১শ ডাবের দাম প্রায় ১ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কদিন আগেও ১শ ডাব কিনেছি ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকায়। তবে বর্তমানে সেটি কিনতে হচ্ছে ১০ হাজার থেকে ১১ হাজার টাকায়। ছোট সাইজের ডাব হলে হয়তো কিছু কমে মিলছে। একই কথা জানান, চৌরাস্তার ডাব বিক্রেতা মাহবুব। গরম না কমলে শিগগিরই বাজারে ডাবের সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কার কথা জানালেন তারা। তারা জানান, প্রতি বছর বৈশাখ মাসে এমনিতেই বাড়ে ডাবের দাম। তবে এ বছর তীব্র গরম পড়ায় সেটি আরও বেড়েছে। গত বছর ডেঙ্গুর সময়ও ডাবের দাম এতো বাড়েনি। তবে এবার যশোরে গরম বাড়ায় ডাবের চাহিদা প্রচুর বেড়েছে। তারা আরও বলেন, গ্রামেও বেড়ে গেছে ডাবের দাম। আগে যেখানে ছোট সাইজের ডাব ৩০-৪০ টাকায় পাওয়া যেত, সেটি এখন কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকায়। এর সঙ্গে রয়েছে পরিবহন ও শ্রমিক খরচ। সব মিলিয়ে কয়েকবার হাত বদলের মাধ্যমে ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সেটি গিয়ে ঠেকছে অন্তত ১শ থেকে ১৪০ টাকায়।
এদিকে ভোক্তারা বলেন, গত বছর ডেঙ্গুর সময় ডাবের চাহিদাকে পুঁজি করে দাম বাড়ানোর খেলায় মেতেছিলেন বিক্রেতারা। আর এবার মেতেছেন গরমকে পুঁজি করে। তাদের এ অসাধু সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে পকেট ফাঁকা হবে ক্রেতাদের।
নাগরিক অধিকার আন্দলনের সমন্বয়ক শেখ মাসুদুর রহমান মিঠু বলেন, চাষি থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে কয়েকটা হাত বদল হয়। দাম বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ এটা। এছাড়াও তিনি বলেন, সরকারের উচিত যোগ্য লোককে মন্ত্রণালয়ে বসানো। যিনি চাষি থেকে সরাসরি ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য বাজার ব্যবস্থাপনা তৈরি করবে। এতে করে ডাবসহ প্রতিটি ফসল-সবজির দাম নিয়ন্ত্রনে থাকবে।
জেলা ডেপুটি সিভিল সার্জন নাজমুস সাদিক রাসেল বলেন, তীব্র গরম ও তাপদহে ক্লান্তি, অবসাদ দূর করতে এবং পানি শূন্যতা প্রতিরোধে ডাবের পানি কার্যকর ভূমিকা রাখে। ডাবের পানিতে চারটি কলার সমান পটাসিয়াম ও প্রাকৃতিক শর্করা আছে। ডাবের পানি শরীরকে সতেজ করে ও শক্তির যোগান দেয়। এ ছাড়াও ডাবের পানিতে রয়েছে উচ্চমাত্রার ক্যালসিয়াম যা হাড়কে মজবুত করে। ডাবের পানি হজমের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করাসহ বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে।
ডাবের বাজারের যখন এ অবস্থা, তখন অস্থির অন্যান্য ফলের বাজারও। রমজানের তুলনায় দাম সামান্য কমলেও এখনও বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে বেশিরভাগ ফল। বয়কটের ভয়ে বাজারে কমে যাওয়া তরমুজের দাম ফের বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে এর কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়।