লাঙল আঁচড়া মই কাস্তেসহ কৃষি যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রতিবাদ
‘রাজনীতি বুঝিনে বাপু মাঠ থেকে পানি সরুক’
রায়হান সিদ্দিক: কনক্রিটের ওপর কলানো বীজ ধান ছেটানো, পাশেই পড়ে আছে লাঙল, কাস্তে, মই, আঁচড়া। এগুলো সবই কৃষি কাজের উপকরণ। আর এগুলোর চারপাশ ঘিরে বসে আছে শত শত কৃষক। কনক্রিটের ওপর বীজ ধান ছেটানোর কারণ জানতে চাইলে উপস্থিত একজন বলেন, আমরা কৃষক মানুষ। কৃষিকাজ করেই জীবন যাপন করি। আমরা বাপু ওত রাজনীতি বুঝিনে। শুধু চাই মাঠেরতে পানি সরে যাক।
ঘরবাড়িতে উঠতি পারতিছিনে। ঘরের ভেতর মাজা সুমান পানি। রান্নাঘর, গোয়াল, বাথরুম সবই পানির ভিতর। সরকার ধানের বীজ দেছে তা লাগাবো কনে ধানি জমি সব ডুবে গেছে তাই এখানে ফেলায় আন্দোলন করতি আইছি।
গতকাল রোববার যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যলয়ের সামনে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির অনির্দিষ্টকালের অবস্থান কর্মসূতিতে উপস্থিত শত শত কৃষক ও পানিবন্দী ভুক্তভোগীরা লাঙল, কাস্তে, মই, আঁচড়া নিয়ে নিজেদের দুর্দশার কথা জানাতে মনিরামপুর কুলটিয়া পারিয়ালী থেকে এসেছিলেন।
উপস্থিত আন্দোলনকারি সকলের একটিই দাবি এবারের অবস্থান কর্মসূচি ততদিন চলবে যতদিন না পরিকল্পিত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ভবদহ জনপদের ২০০ গ্রামের ১০ লাখ মানুষ মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে রয়েছে। সে কারণে যশোরের দুঃখ বলা হয় ভবদহকে। সে দুঃখ ঘোচাতে গত ৪১ বছরে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। প্রকল্পের নামে সরকার খরচ করেছে কোটি কোটি টাকা। তবে এখনো জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হয়নি।
এখন চলছে বোরো মৌসুম। কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে ভবদহ এলাকার গ্রামে গ্রামে এখনো পানি জমে আছে। অনেকের উঠানে এখনো কোমর পানি। ফলে শত শত একর জমি এবার আবাদ না হওয়ার শঙ্কায় রয়েছে। ফলে কৃষির ওপর নির্ভরশীল এই জনপদের মানুষ আছেন মহাসংকটে। তবে এই সংকটকে পুঁজি করে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও একশ্রেণির স্বার্থন্বেষী গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দিনের পর দিন।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতাদের দাবি, ভবদহ অঞ্চলকে মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রস্তাবিত ‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প বাতিল করতে হবে। একই সাথে মাঘী পূর্ণিমার আগে বিল কপালিয়া টিআরএম চালু করতে হবে।
টিআরএম প্রকল্প গ্রহণ না করে ভবদহ স্লুইস গেট থেকে প্রায় ৫০-৬০ কিলোমিটার নদী মেরে ফেলা হয়েছে। এক্ষেত্রে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সরকারের নদী বাঁচানোর গৃহীত নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা জনগণকে স্থায়ী জলাবদ্ধতায় জিম্মি করে অর্থ লোপাটের স্থায়ী পরিকল্পনা ফেঁদেছে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে সহজ ও পরীক্ষিত সমাধান টিআরএম না করার জন্য জেদ ধরেছে।
এমন পরিস্থিতিতে জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে এই মুহূর্তে বিল কপালিয়ায় টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) বাস্তবায়ন, নদী রক্ষা, হরি শ্রী নদীতে পড়া পলি অপসারণ ও পলি মাটি নদীগর্ভে নয়- নদী পাড়ের বাইরে ফেলা, পলিতে ভরাট হয়ে যাওয়া টেকা-মুক্তেশ্বরী নদী সংস্কার, আমডাঙ্গা খাল প্রশস্থ ও গভীর করা, আমডাঙ্গা খালের স্লুইচগেটের পূর্বাংশে অবিলম্বে খালের দুপাশে স্থায়ী টেকসই প্রাচীর নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ, লুটপাটের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত ৫০ কোটি টাকার সেচ প্রকল্প বাতিল, সমস্ত কাজ সেনাবাহিনীর তত্বাবধায়নে কার্যকরী এবং আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোকে কাজ মনিটরিংয়ের সুযোগ দেওয়ার দাবি করা হয়।
সরকারকে মিথ্যা তথ্য প্রদান, নদী হত্যা, জনপদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা, ফসল, বসতবাড়ি ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে জড়িত পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবী তোলেন আন্দোলনকারীরা।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজসে ভবদহবাসীকে ডুবিয়ে মারার একের পর এক ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। আমরা দাবি করছি আমডাঙ্গা খাল প্রসস্থ করে খনন, বিল কপালিয়ায় টিআরএম এবং পর্যায়ক্রমে বিলে বিলে টিআরএম চালু করে নদীর নাব্যতা রক্ষা ও জলাবদ্ধতার অবসান এবং উজানে পদ্ম-মাথাভাঙ্গা-ভৈরবের নদী সংযোগের সাথে মুক্তেশ্বরী নদীকে যুক্ত করে প্রবাহমান করার। তা হলেই সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে প্রতিশ্রুতি ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মাধ্যমে জনগণের সাথে অব্যাহত প্রতারণা করা হচ্ছে। এজন্য দাবি আদায়ে আমরা এই লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি দিয়েছি।
আহ্ববায়ক রনজিৎ বাওয়ালী বলেন, দীর্ঘ আন্দোলনের পরও ভবদহের ছিয়ানব্বই গ্রামের মানুষ কোন সমাধান পায়নি। শীতকালেও এখানে প্রায় সব বাড়ি হাটু সমান পানি। মানবতার জীবনযাপন করছে কয়েক হাজার পরিবার। তাই এবার কঠোর অবস্থান কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময় আমরা মানববন্ধন, প্রেসমিটিং, জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে স্বারকলিপি দিয়েছি কিন্তু কোন কিছুতেই কোন কাজ হয়নি। ২০২১ সালেই পানিতে ডুবে মারা গেছে ১ শিশুসহ ৪ জন। এদিকে নদী মেরে ফেলায় কেশবপুরের ২৭ বিলও জলাবদ্ধ হয়ে গেছে। তাই এবারের অবস্থান কর্মসূচী অনির্দষ্টকালের জন্য যতদিন পর্যন্ত আমরা সঠিক কোন সমাধান না পাবো আমাদের এই কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে।
যুগ্ম আহ্ববায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী আব্দুল হামিদ বলেন, ভবদহের স্থায়ী জলবদ্ধতা নিরসনে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড যৌথ উদ্যোগে সেচ প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেও ভবদহ স্লুইস গেট দিয়ে ভবদহবাসির জন্য কোন সুফল বয়ে আনতে পারেনি। নদীর তলদেশ পলিতে ভরে যাওয়ায় বিলের পানি কোথাও যেতে পারছে না। যার কারণে চড়ম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষের। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দোষারোপ করে তিনি বলেন, ভবদহকে পুজি করে অনেকেই অর্থের পাহাড় গড়ছেন। এদিকে সাধারণ মানুষ না খেতে পেয়ে মরছে। আমরা এর স্থায়ী সমাধান চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি একটাই, হয় আমাদের মেরে ফেলেন না হয় আমাদের এই দুর্দশা থেকে মুক্তি দেন।
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা, অ্যাডভোকেট আবুল হোসেন, নাজিম উদ্দীন, জিল্লুর রহমান ভিটু, সদস্য সচিব চৈতন্য পাল, নারী মুক্তি নেত্রী জাহানারা মুক্তা প্রমুখ।
অবস্থান কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করেন, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ যশোর জেলা শাখার সভাপতি দীপংকর দাস রতন, বাপার জেলা আহ্ববায়ক খন্দকার আজিজুর হক মনি, জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান বুলু, বাঘারপাড়া উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বিথিকা বিশ্বাস।