নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশে কৃষি ভান্ডার হিসেবে পরিচিত যশোরের ৩৩ হাজার হেক্টর জমির আবাদ বর্তমানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সদর উপজেলায় কৃষি অফিসার হিসেবে রাজিয়া সুলতানার জুন মাসে যোগদানের পরই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে কৃষকরা বলছেন। একই কথা বলছেন জেলা ও উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তারাও। তাদের অভিযোগ, রাজিয়া সুলতানা ঠিকমতো অফিসে যান না। যান না মাঠেও। কৃষকদের কোনো পরামর্শ দেওয়ারও ধার ধারেন না তিনি। অফিস না করলে কী হবে, ঠিকই সরকারি গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহার করছেন এই নারী কৃষি কর্মকর্তা।
একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে সকাল সাতটা থেকে সরকারি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার শুরু করেন রাজিয়া সুলতানা। প্রথমে তিনি সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে তার সন্তানকে গাড়িতে করে যশোর ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজে নিয়ে যান। সেখান থেকে ছুটি হলে শহরের খালধার রোডের আখপট্টির বাসায় নিয়ে যান। এরপর নিয়ে যান খেলার মাঠে। সেখান থেকে শহরের নোভা ক্লিনিকের পাশে একজন টিউটরের কাছে নিয়ে যান। রাত সাড়ে সাতটায় ছুটি হলে সেখান থেকে ফের বাসায় নিয়ে যান রাজিয়া সুলতানা। সব জায়গায়ই সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন তিনি।
সদর উপজেলার সাবেক কয়েকজন কৃষি অফিসার জানিয়েছেন, সরকারি গাড়ি কেবল সরকারি কাজেই ব্যবহার করার নির্দেশনা রয়েছে। এর বাইরে কোনোভাবেই ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যাবে না। সোমবার নোভা ক্লিনিকের পাশের টিউটরের বাসা থেকে সন্তানকে নিতে রাজিয়া সুলতানা তার সরকারি গাড়ি নিয়ে হাজির হন রাত ৭.২১মিনিটে। সেখান থেকে সন্তান নিয়ে গাড়ি ছাড়েন রাত ৭.৪২ মিনিটে। আবার সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে সন্তান নিয়ে হাজির হন যশোর ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখান থেকে আনেন ১১ টার পর। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, যোগদানের পর থেকেই আইনকানুনের থোড়াইকেয়ার করে রাজিয়া সুলতানা চলছেন ইচ্ছেমতো। তিনি কাউকেই তোয়াক্কা করছেন না। তার মধ্যে সবকিছুতেই ড্যামকেয়ার ভাব। জেলা কৃষি অফিসের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাজিয়া সুলতানা খোদ জেলা কৃষি কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেনের ফোন রিসিভ করেন না। মানতে চান না তার নির্দেশনাও।
কৃষি বিভাগে চাউর রয়েছে, রাজিয়া সুলতানা ১০ লাখ টাকা খরচ করে খুলনার ফুলতলা থেকে যশোরে এসেছেন। এখন তার একটায় কাজ ওই টাকা তোলা। যশোরের কৃষি গোল্লায় গেলেও তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। একাধিক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কৃষি অফিসার রাজিয়া সুলতানা সার ডিলারদের নাকি বলেছেন,‘সার যেখানে যেভাবে বিক্রি করুক তা নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। মাস গেলে তাকে ‘খাম’ দিতে হবে। তার এ ধরনের কথায় কোনো কোনো ডিলারের মধ্যেও ক্ষোভ বিরাজ করছে।’
কমপক্ষে পাঁচজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বলেছেন,‘কৃষি অফিসার যোগদানের পর মাঠে যাননি বললেই চলে। তিনি কৃষককে কোনো পরামর্শ দিতে চান না। অথচ এর আগের সব কৃষি কর্মকর্তা বেশিরভাগ সময় মাঠেই থাকতেন। কৃষি অফিসার অধিকাংশ দিন ১১ টার পরে অফিসে যান।’ তিনি যে ১১ টার পরে অফিসে যান তার প্রমাণ রয়েছে। এরমধ্যে একদিন সাড়ে ১১ টার দিকে অফিসে আসেন রাজিয়া সুলতানা। আর একদিন দুপুর দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করেও তার দেখা মেলেনি।
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, রাজশাহী অঞ্চলের লোক হয়েও তারা স্বামী-স্ত্রী বিভিন্ন সরকারের সময় বেপরোয়াভাবে চলেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারা নাকি মাহবুবুল আলম হানিফের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে যা খুশি তাই করেছেন। আর এখন হয়েছেন বিএনপির লোক! যদিও সর্বশেষ তার স্বামী শাহিনুর রহমানকে দুর্নীতির দায়ে ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলা কৃষি অফিসারের দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়। বর্তমানে তিনি মাগুরার বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিতে কর্মরত।
সূত্র জানিয়েছে, যশোর সদর উপজেলায় ২৮ জন সার ডিলার রয়েছে। ৮১ টি রয়েছে রি-ডিলার পয়েন্ট। এসব জায়গায় সার কী হচ্ছে না হচ্ছে এটি কখনও যাচাই করার প্রয়োজনবোধ করেননি উপজেলা কৃষি অফিসার। ফলে, অনেক ডিলার-রিডিলার সার নিয়ে যা খুশি তাই করছেন বলে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের দাবি।
সদর উপজেলার সবজি জোন খ্যাত চুড়ামনকাটি ও লেবুতলা ইউনিয়নের একাধিক কৃষক বলেন,‘নতুন কৃষি অফিসারকে আমরা কখনো মাঠে দেখিনি।’
এসব বিষয়ে জানতে উপজেলা কৃষি অফিসার রাজিয়া সুলতানাকে ফোন করলে প্রথমে তিনি রিসিভ করেননি। এরপর রাত ৮.৩৮ মিনিটে ফোন করেন তিনি। তখন তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে বলেন,‘আপনিতো আমার গাড়ির ছবি নিয়েছেন। আমি রাত ৭.১৫ মিনিটে অফিস থেকে বের হয়েছি। এর বাইরে আমি ফোনে কিছু বলতে চাই না।’ রাতে কেন অফিস থেকে বের হয়েছেন জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
এরপর রাত ৮.৪৮ মিনিটে দ্বিতীয়বার ফোন করে ধমকের সুরে তার অফিসে যেতে বলেন। কী কারণে অফিসে যেতে হবে জানতে চাইলে বলেন,‘আমার কাছে যেসব বিষয়ে জানতে চেয়েছেন সে বিষয়ে শুনতে।’ জবাবে এ প্রতিবেদক বলেন, আপনার অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। যদি কিছু বলার থাকে ফোনে বলতে পারেন। এরপর তিনি লাইন কেটে দেন।
তার বিষয়ে জানতে জেলা কৃষি কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেনের কাছে ফোন করলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। ফোন রিসিভ করেননি যশোরাঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক আলমগীর হোসেন বিশ্বাসও।
আরও পড়ুন: পাঁচটি সমঝোতা স্মারক ও তিনটি নোট বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর