তবিবর রহমান
এক সময় পাড়ায় পাড়ায় দেখা মিলতো ঢেঁকি। ঢেঁকিছাঁটা পুষ্টিসমৃদ্ধ চালের চাহিদাও ছিল তুঙ্গে। এখন ঢেঁকি নেই। গায়ের বধূদের একত্রিত হয়ে ঢেঁকি পাড়ানোর চিত্রও দেখা যায় না। তবে ঢেঁকি ঘিরে গায়ের বধূদের জটলা চোখে পড়বে যশোরের একটি গ্রামে। পা ও গায়ের শক্তি ছাড়াই অটোমেটিক ঢেঁকি পাড়ানোর দৃশ্য দেখতে সেখানে ভিড় করছেন নারীরা।
ঢেঁকি শিল্পের ঐতিহ্যে প্রযুক্তির ছোয়া দিয়েছেন যশোর সদরের ফতেপুর ইউনিয়নের পশ্চিম চাঁদপাড়া গ্রামের মাহাবুবুর রহমান। উদ্ভাবন করেছেন বৈদ্যুতিক ঢেঁকির। যা ‘ডিজিটাল ঢেঁকি’ নামে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেছে। তার ‘ডিজিটাল ঢেঁকি’তে ধুম পড়েছে নতুন ধানের চাল ও আটা তৈরির। ঢেঁকিছাটা চাল ও পিঠা-পুলির জন্য আটা করতে দলে দলে আসছেন বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। থেমে দেখছেন পথচারীরা।
মাহাবুবুর রহমান দরিদ্র পরিবারের মানুষ। ১০-১২ বছর বয়সে যুক্ত হন কাঠ মিস্ত্রির পেশায়। তৈরি করেছেন পা দিয়ে চালিত অসংখ্য ঢেঁকি। তৈরি করতে করতে ভাবতেন এটা যদি যন্ত্রের মাধ্যমে চালিত করা যেত, তাহলে নারীদের কায়িক শ্রম লাঘব ও অর্থ সাশ্রয় হতো। সেই সংকল্প ধরা দিয়েছে তাকে। গত তিন বছর আগে তৈরি করেন ডিজিটাল ঢেঁকি। কিন্তু প্রথমবার সেটা যুতসই-টেকসই হয়নি
। ৭/৮ মাস হলো আধুনিক পদ্ধতিতে স্থাপন করেন ‘ডিজিটাল ঢেঁকি’। বিদ্যুতের স্লুইচ অন করলেই ঢেঁকিতে ধান ভাঙানো শুরু হচ্ছে।
প্রাচীন ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল বের করা হতো ঢেঁকির একপ্রান্তে পা দিয়ে পালাক্রমে চাপ প্রয়োগ করে বা পাড় দিয়ে। আর এ ঢেঁকিতে বিদ্যুতের মাধ্যমে মোটরচালিত লোহার হাতল দিয়ে পালাক্রমে চাপ দিয়ে ধানের তুষ ছাড়িয়ে চাল বের করা হয়। এতে সময়, শ্রম ও খরচ হচ্ছে কম। এছাড়া প্রস্তুত করা হচ্ছে ঢেঁকি ছাটা চাল। এ চালের ফাইবার নষ্ট না হওয়ায় পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং স্বাস্থ্যসম্মত হচ্ছে।
মাহাবুবুর রহমান জানান, নিজে এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক হলেও তিনি ডিজিটাল ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল করতে শ্রম দিচ্ছেন। একাজে তার স্ত্রী শাপলা খাতুন ও বৃদ্ধা মাতা সালেহা খাতুন সহযোগিতা করে থাকেন। এ ঢেঁকির মাধ্যমে দিনে ৫-৬ মণ ধান এবং ১০০ কেজি চাল থেকে গুড়া করা সম্ভব বলে জানালেন তিনি।
চাঁদপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মনিরুজ্জামান বলেন, আমাদের মা-চাচীদের পায়ের ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল করতে খুবই কষ্ট হতো। রমজানের ছুটিতে বাড়ি এসে দেখি মাহাবুবুর রহমান বিদ্যুতের সাহায্যে মেশিনের মাধ্যমে ঢেঁকি চালিয়ে ধান থেকে চাল ও চাল থেকে গুড়া করছেন। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছে। নারীদের আগে অনেক কষ্ট হতো। এই প্রযুক্তির কারণে সহজেই ঢেঁকি ছাটা চাল পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধরনের উদ্যোগ এগিয়ে নিলে ঢেঁকি ছাটা চাল মিলবে আগের মতোই। গ্রামীণ ঐতিহ্য পিঠা-পুলির সমারোহ থাকবে সারা বছর।
স্থানীয় তরুণ আরিফুজ্জামান বলেন, মেশিনের ঢেঁকিতে চাল কোটায় অল্প সময় লাগছে। চাল ও চালের গুড়া করার জন্য প্রায় দিনই লাইন দিতে দেখা যায়। এখন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসছে ঢেঁকি ছাটা চাল করতে।
ওই মিলের পাশেই বাড়ি গৃহবধূ লাবনী খাতুনের। তিনি বলেন, বাড়ির কাছে ডিজিটাল ঢেঁকি স্থাপন হওয়ায় এলাকার নারীদের খুব সুবিধা হয়েছে। আমরা অনায়াসে চাল ও চালের গুড়া তৈরি করে নিচ্ছি। এই প্রযুক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা গেলে বাংলার নারীদের কষ্ট লাঘব হবে।
শাহিনা খাতুন নামে আরেক নারী বলেন, এই ঢেঁকি পায়ে চালিত ঢেঁকির চেয়ে ভালো। আমি নিজে সেখান থেকে চালের গুড়া করে নিয়েছি। সেই গুড়া থেকে অনেক ভালো পিঠা হয়েছে। নিজ গ্রামে এরকম সুবিধা পাওয়ায় নারীরা দলে দলে চালের গুড়া করতে আসছেন।
জানতে চাইলে ফতেপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ সোহরাব হোসেন বলেন, ঢেঁকির জায়গা দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন অটোরাইস ও হাস্কিং মিল। এজন্য ঢেঁকিছাঁটা চাল কমই পাওয়া যায়। মাহাবুবুর নিজ চেষ্টায় প্রযুুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটাল ঢেঁকি করেছেন। এলাকার মানুষ পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল পাচ্ছেন। ইউনিয়ন পরিষদ তার এই ভালো উদ্যোগের সাথে রয়েছে।