কল্যাণ ডেস্ক
পৃথিবীতে কোন দেশে প্রথম বেতনের সঙ্গে ঈদ উৎসবে বোনাস দেয়া শুরু হয়েছিল? নিঃসন্দেহে এই প্রশ্নের জবাবে কেউ ভারতবর্ষের কোনও শাসক বা সরকারের নাম মুখে আনার কথাও ভাববেন না।
কিন্তু ইতিহাসের কিছু তথ্য বলছে, ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশেষ বোনাস বা ভাতা প্রথমদিকে ভারতীয় উপমহাদেশেই প্রচলনের শুরু হয়। তবে সেটি পৃথিবীতে প্রথম কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। তবে আরেকটি বিস্মিত করার মতো তথ্য হচ্ছে , ঈদ উৎসবে বাংলাতেই ইতিহাসে প্রথম ভাতা চালুর নজির পাওয়া যাচ্ছে!
বাংলায় রোজা ও ঈদের ইতিহাস
অষ্টম শতকের থেকেই বাংলায় সুফি, দরবেশ ও তুর্কি-আরব বণিকরা আসতে শুরু করেন এবং তাদের দ্বারাই প্রথম এ অঞ্চলে ঈদ প্রচলন হয়। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত আব্বাসীয় খলিফাদের সময়কার রৌপ্য মুদ্রা থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান লিখেছেন, “এ দেশে রোজা পালনের প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় ‘তাসকিরাতুল সোলহা’ গ্রন্থে। এ গ্রন্থে দেখা যায়, আরবের জনৈক শেখউল খিদা হিজরি ৩৪১ সাল মোতাবেক ৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় আসেন।”
সে যাই হোক মুদ্রা গবেষকদের গবেষণাতেই পরবর্তীতে বাংলায় ঈদ বোনাস চালুর বিষয়টি পরোক্ষভাবে উঠে আসে।
বাংলায় মুসলিমদের শাসন শুরু হয় ১২০৫ সালে। তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী প্রথমে ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে বিহার জয় করেন। পরে ভারতে মুহম্মদ ঘুরীর প্রতিনিধি কুতুবউদ্দীন আইবেকর সাথে বদাউনে গিয়ে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ করেন। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে তিনি সৈন্যবাহিনী আরও শক্তিশালী করেন।
১২০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দে আকস্মিকভাবে বাংলা আক্রমণ করে রাজা লক্ষ্মণ সেনের সাময়িক রাজধানী নদীয়া অধিকার করেন কুতুবউদ্দীন আইবেক। এরপর তিনি বাংলার ঐতিহ্যবাহী রাজধানী গৌড় দখল করে সেখানে তার রাজধানী স্থাপন করেন এবং প্রায় দুই বছরকাল বিজিত রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠামো বিন্যাস ও ব্যবস্থাপনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
মুসলিম শাসনের এ ধারাবাহিকতায় বাংলায় সুলতানি আমলের শুরুর দিকে ১২১০ সালে রুকনুদ্দিন আলী মর্দানের নামে একটি রৌপ্যমুদ্রা চালু ছিল। একই ধরনের রৌপ্যমুদ্রা চালু ছিল আরেক দিল্লীর সুলতান মোহাম্মদ বিন শাম এর সময়েও।
‘টংক’ নামের এই মুদ্রাটির আকার ছিল হরিকেলার রৌপ্য মুদ্রার মতোই। ভারতীয় এক তোলার কিছু বেশি বা কম ওজনের এবং এই মুদ্রাতেও তখন প্রচলিত সোনার মুদ্রার মতো ঘৌড়-সওয়ারের ছবি অঙ্কিত ছিল। এই ‘টংক’ মুদ্রাটি সব সময়ই রোজার মাসে প্রচলন করা হতো। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত মু্দ্রার গায়ের তারিখ অন্তত তা-ই বলছে। যা থেকে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন- এটি রাজকর্মচারীদের বোনাস বা উৎসব ভাতা মানে ঈদের জন্য বিশেষভাবে দেওয়া হতো। আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, রাজকর্মচারীরা অবসরে যাওয়ার সময় তাদেরকে এই মুদ্রা দেওয়া হতো পেনসন বাবদ।
তবে এটি কতদিন পর্যন্ত চলেছে তার কোনও ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। (তথ্যসূত্র: THE TRANSITION FROM ANCIENT TO MEDIEVAL IN BENGAL’S MONETARY REALMS, John S. Deyell)
পৃথিবীতে প্রথম ঈদ বোনাস
ইতালিতে ১৯৩৭ সালে কারখানা শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকেরা চুক্তিবদ্ধ হয়ে প্রথম ‘গ্রাটিফিকা নাটালিজিয়া’ বা ‘ক্রিসমাস উপহার’ চালু করেন। এর আগে থেকেই অবশ্য বড়দিন উপলক্ষে মালিকরা নিজ কারখানার শ্রমিকদের এ উপহার দিতেন। তবে তা কোনও গৎবাধা নিয়মের মধ্যে পড়তো না।
১৯৪৬ সালে ইতালির অন্যান্য কর্মক্ষেত্রেও একই নিয়ম চালু হয়। ১৯৬০ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে ক্রিসমাস বোনাসকে আরও পোক্তভাবে চালু করা হয়।
এ তো গেলো ক্রিসমাস বোনাসের ইতিহাস। তাহলে ঈদ উপলক্ষে আধুনিক দুনিয়ায় কবে থেকে বোনাস প্রথম চালু হয়? ঐতিহাসিকদের মতে, এখন আমরা যে ঈদ উৎসব দেখি তা পালন করতে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের মধ্যে প্রথম ঈদ বোনাস চালু হয়েছিল অন্যতম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে পরিচিত ইন্দোনেশিয়ায়। ১৯৫০ সালে চালু হওয়া ওই ঈদ বোনাসের নাম ‘তুজানা হারি রায়া’, বাংলা করলে যা দাঁড়ায় ‘ধর্মীয় উৎসব ভাতা’। ইন্দোনেশিয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলে এই উৎসব ভাতার পরিমাণ ও নীতি একেকরকম। যেমন- জাকার্তায় বেতনের ১০০ শতাংশই ঈদের আগের মাসে শ্রমিক বা কর্মচারীদের দিতে হয়। এটি দেশটির আইনে বাধ্যতামূলক। নইলে শাস্তির বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশে ঈদ বোনাস
সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে এরশাদ ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরেই সরকারি কর্মচারিদের উৎসব ভাতা চালুর ঘোষণা দেন। ১৯৮৪ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে রোজার ঈদ। ওই ঈদের আগেই জুন মাসের দুই তারিখে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রথমবারের মতো ঈদ বোনাস চালু হয়। ১৯৮৯ সালে চালু হয় রাষ্ট্রায়ত্ত কিছু খাতে শ্রমিকদের মধ্যে বোনাস দেওয়ার প্রথা। মূল বেতনের ৫০ শতাংশ হারে দুই ঈদে এই বোনাস দেওয়ার প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছিল।
তবে গার্মেন্টস-টেক্সটাইল খাতসহ শ্রম আইনে এই ঈদ বোনাসের প্রথা নিয়মিতভাবে শুরু হয় আরও বহু ঘাম ঝরানোর পর। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০১৫ সালের পাস হওয়া শ্রম বিধিমালার বিধি ১১১ (৫) অনুযায়ী বোনাস বাধ্যতামূলক করা হয়। এটি অনুযায়ী কোনও কর্মীর চাকরির মেয়াদ এক বছর হলেই বছরে দুইটি উৎসব ভাতা পাবেন।
এছাড়াও ২০১৮ সালের অক্টোবরে সংশোধনীর মাধ্যমে উৎসব ভাতা না দিলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বলা হয়।
দ্য থারটিনথ স্যালারি কনসেপ্ট
কেবল তের নয়, বারো মাসে চৌদ্দ বেতনের সঙ্গে পৃথিবী এখন অনেকটাই পরিচিত। বেশিরভাগ দেশই বছরের শেষে একটি বোনাস দেয়। যা মূলত ক্রিসমাস উপলক্ষেই দেওয়া। আবার কোনও কোনও দেশ বছরের মাঝেও দেয়। সেই হিসেবে বাংলাদেশও ১৪টি বেতন দিয়ে আসছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বৈশাখী ভাতা।
তবে একথা শুনলে বিস্মিত হতে হয় যে, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের মূল বেতনের পুরো অংশ, সরকারি বিধি অনুযায়ী মূল বেতনের ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা দেওয়া হলেও, এখন পর্যন্ত দুই ঈদে শিক্ষকদের মূল বেতনের ২৫ শতাংশ এবং কর্মচারীদের ৫০ শতাংশ উৎসব ভাতা দেওয়া হয়।