শাহারুল ইসলাম ফারদিন
দেশের বেশিরভাগ জেলায় বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। অসহনীয় গরমে নাকাল মানুষ। তাপমাত্রা কিছুটা কমবেশি হলেও বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি অনুভূত হচ্ছে বেশি। এ অবস্থা থেকে সহজে মুক্তিও মিলছে না। আগামী কয়েকদিনও চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। গতকাল রোববার (২১ এপ্রিল) দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এ আবহাওয়াবিদ বলেন, বাতাসের কারণে তাপমাত্রা কিছুটা কমেছে। কিন্তু হিটওয়েভ কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। আগামী কয়েকদিন চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা, পাবনা জেলায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এদিকে, গত কয়েক দিনে যশোরে লাগাতার তাপপ্রবাহে অতিষ্ঠ জনজীবন। প্রচণ্ড তাপমাত্রার কারণে যশোরের বিভিন্ন স্থানে সড়কের বিটুমিন গলে যাচ্ছে। ডায়রিয়াসহ গরমজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিরুল আজাদ জানান, গত রোববার বিকাল তিনটায় যশোরে তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসে আর্দ্রতা ছিল ৩০ শতাংশ। এর আগের দিন শনিবার (২০ এপ্রিল) জেলায় তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রতিদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। তীব্র তাপপ্রবাহে জনশূন্য হয়ে পড়ে সড়কগুলো। মানুষের উপস্থিতি যেমন কম, তেমনি যানবাহনের উপস্থিতিও নেই বললেই চলে।
এদিকে যশোরে কয়েকদিন তীব্র তাপদহ থাকায় হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গতকাল রোববার যশোর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে তিনগুণ রোগী ভর্তি রয়েছে।
যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় গরমজনিত রোগে শিশু ওয়ার্ডে ৭১, ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ২৪, পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে ১৯ এবং মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে ১৬ জন ভর্তি হয়েছে। এছাড়া, এ সময়ে তীব্র গরমে স্ট্রোক করে আটজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অর্থাৎ একদিনে গরমে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে একশ ৩২ জন ভর্তি হয়েছে। এছাড়াও, বহির্বিভাগ থেকে গরমজনিত রোগে চিকিৎসা নিয়েছেন দুইশ ৭৭ জন। এরমধ্যে শিশু বিভাগে একশ ৫৬, পুরুষ মেডিসিন বিভাগে ৮১ এবং নারী মেডিসিন বিভাগ থেকে ৭৩ জন চিকিৎসা নিয়েছেন।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে গত ২৪ ঘণ্টায় রোগী ভর্তি হয়েছে ২৪ জন। আগের রোগী মিলিয়ে বর্তমানে রয়েছে ২৮ জন। এর মধ্যে শিশু ১২, নারী এবং পুরুষ ৯ জন। শিশুদের মধ্যে তিন জন হাম, পক্স ও টিটেনাস আক্রান্ত। অন্য সবাই ডায়রিয়া রোগী। হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স হোসনে আরা খাতুন এ তথ্য দিয়েছেন। শিশু ওয়ার্ডে ২৫ বেডের বিপরীতে গত ২৪ ঘন্টায় ভর্তি রয়েছে ৭১ জন শিশু রোগী। তার মধ্যে অধিকাংশ রোগী শ^াসকষ্ট, নিউমনিয়া, জ¦রে আক্রান্ত।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক বিচিত্র কুমার মল্লিক বলেন, চলমান তাপপ্রবাহের কারণে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত রোদের মধ্যে বাইরে বের না হওয়াই ভালো। এই গরমে হাসপাতালে ডায়রিয়া, বমি, পেটে ব্যথার রোগীর ভর্তিও সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যাই বেশি।
যশোর মেডিকেল কলেজের নিউরো মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক আলাউদ্দিন আল মামুন বলেন, অতিরিক্ত তাপে ডায়রিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি-কাশি, পক্স, হিট স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক প্রভৃতি হতে পারে। সুস্থ থাকতে ডিপ ফ্রিজের পানি পান করা যাবে না। প্রচুর পানি, ডাবের পানি ও দেশি ফলমূল খাওয়া প্রয়োজন।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাক্তার আব্দুস সামাদ বলেন, এই গরমে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, হার্ট ও কিডনি রোগী। গরমের কারণে বেশির ভাগ শিশু ডায়রিয়া আক্রান্ত হচ্ছে। এই গরমে স্ট্রোক, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া প্রভৃতি রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়।
রোদে বাইরে বের হলে ছাতা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে ডাক্তার আব্দুস সামাদ বলেন, সকলের উচিত সুতির ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করা। এখন প্রচুর পরিমাণে সুপেয় পানি, ডাবের পানি, স্যালাইন, দেশি ফলমূল খাওয়া উচিত। পচা ও বাসী খাবার যেন কেউ না খায়।
যশোরের জেলা প্রশাসক আবরাউল হাছান মজুমদার বলেন, কেন্দ্রীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর গত ১৬ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় দফায় যশোর ও চুয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন জেলায় হিট এলার্ট জারি করেছে। প্রখর রোদ ও তাপদাহে মানুষকে সতর্ক করতে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরাও :
অতিরিক্ত গরমে ছোট আম ঝড়ে পড়ছে। ধানের খেত ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যমতে, এতে ফলন কম হতে পারে। তবে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পরামর্শ দিয়েছে, আমচাষিদের গাছের গোড়ায় পানি দিতে। আর ২ শতাংশ বলাইনাশক ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে ছিটাতে বলা হয়েছে। এছাড়া ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক কর্মকর্তা বলেন, কৃষক ভাইদের ধানগাছের গোড়ায় ৪ ইঞ্চি পরিমাণ পানি বজায় রাখতে বলা হয়েছে। মাঠের কাজে নিয়োজিত কৃষকদের ছাতা ব্যবহার এবং বারবার পানি পান করতে বলা হয়েছে।
গরমে যশোরে বিভিন্ন সড়কের বিটুমিন গলে যাচ্ছে :
লাগাতার প্রচণ্ড গরমে যশোরে বিভিন্ন সড়কের বিটুমিন গলে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে কথা হয় সড়ক বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মাহবুব হায়দার খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাস্তার বিটুমিন গলে যাচ্ছে মূলত তাপমাত্রার কারণেই। গত কয়েক দিন ধরে যশোরে প্রচণ্ড তাপমাত্রা বিরাজমান। এই তাপমাত্রায় রাস্তার কোথাও কোথাও বিটুমিন গলে যাচ্ছে এমন খবর আমাদের কাছে রয়েছে।’
যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে সহনীয় সড়কে ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়। পরে আরও বেশি তাপমাত্রা সহনশীল সড়কে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু কিছু রাস্তা বেশ কয়েক বছর আগে তৈরি। সেখানে মূলত ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে। সে কারণেও এগুলো গলে যেতে পারে।
গত ১৯ এপ্রিল যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তার আগের দিন বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৭ এপ্রিল ছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ১৬ এপ্রিল তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।