নিজস্ব প্রতিবেদক: মিলনায়তন জুড়ে পিনপতন নিরবতা। গভীর অভিনিবেশ সবার মধ্যেই। মুগ্ধ হয়ে শুনছেন দুই গুণী ব্যক্তির কৃতিত্বগাথা। শনিবার বিকেলে যশোর শিল্পকলায় ছিলো দৈনিক কল্যাণের গুণীজন সম্মাননা। জাতীয় পদকপ্রাপ্ত দু’জন খ্যাতিম্যান ব্যক্তিত্বকে এদিন সম্মাননা জানানো হয়। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পদকপ্রাপ্ত হোসেনউদ্দীন হোসেন ও একুশে পদকে ভূষিত প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেনকে এদিন দেয়া হয় গুণীজন সম্মাননা। যশোরের প্রাচীন সংবাদপত্র দৈনিক কল্যাণের ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এই গুণী ব্যক্তিদ্বয়কে সম্মাননা জানানো হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, জীবদ্দশায় সম্মাননা প্রাপ্তির ঘটনা খুব বেশি নয়। সাধারণত মূল্যায়নটি হয় যখন তিনি জীবিত থাকেন না। এক্ষেত্রে জাতীয় দুটি পুরস্কার যশোরের জন্য অত্যন্ত গর্বের ও সম্মানের ব্যাপার। তিনি বলেন, অর্থবিত্ত ও ধন দৌলতই সবচেয়ে বড় পরিচয়। দেশের মানুষের মধ্যে সাধারণ এরকম একটি ধারণা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি আসলে সেরকম নয়।
অনুষ্ঠানে সম্মাননা প্রাপ্ত গুণীজনদের নিয়ে আলোচনায় প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, সারা জীবন ধরে কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ ও নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে হোসেনউদ্দীন হোসেনের যে সাহিত্য সৃজন তার মূল্য অসাধারণ। তার লেখার মধ্যে সহজ, সরল, নিষ্পেষিত ও অসহায় মানুষের কথা উঠে এসেছে। অনেক চিন্তা তিনি তার সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। আরেক গুণীজন প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন অনেক যোগ্য ব্যক্তি। তার যোগ্য নেতৃত্বে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় অনেক এগিয়ে গেছে। বিশ^বিদ্যালয়টির আমূল পরিবর্তন এসেছে। তিনি বলেন, গরুর ক্ষুরে ইনফেকশন থেকে যে রোগটি হয় তার ওষুধের উদ্ভাবক তিনি। তার অন্যসব গবেষণার মত এটিও একটি বড় সফলতা। প্রকৃত অর্থে তিনি সাধক পর্যায়ের একজন গবেষক।
অতিথিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন যশোর তিন আসনের এমপি কাজী নাবিল আহমেদ। তিনি বলেন, এতদিন ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে যারা সেবা দিয়ে গেছেন তাদের অবদান যদি আমরা স্মরণ না করি, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করি তাহলে অকৃতজ্ঞ থেকে যাব। তিনি বলেন, একুশে পদক এমন একটি জাতীয় পদক যার মাধ্যমে ব্যক্তি বিশেষের সারা জীবনের সাধনা, কর্ম, সৃজনশীল চিন্তা, অধ্যবসায়সহ সকল কিছুর স্বীকৃতি দেয়া হয়। তিনি বলেন, করোনা মহামারির মধ্যে নমুনা পরীক্ষা, জিনোম সিকোয়েন্সিংসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সেই কঠিন সময়ে যোগ্যতার সাথে তিনি এসব কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অন্যদিকে হোসেনউদ্দীন হোসেন সারা জীবন কাজ করে গেছেন সাহিত্য কর্মের পেছনে। জীবনভর গবেষণা করেছেন ও লব্ধ জ্ঞান দিয়ে বহু লেখা লিখে গেছেন। অন্য সাহিত্যিকদের জন্য তিনি অনুসরণীয়।
যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, সাহিত্যিক হোসেনউদ্দীন হোসেন জীবনভর যেসব সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, গবেষণা করেছেন সেগুলো নিঃসন্দেহে অনেক বড় কাজ। সেগুলো সত্যিকার অর্থেই প্রশংসনীয়। আর তার স্বীকৃতিও তিনি ইতিমধ্যে পেয়েও গেছেন। যেটি এই জেলার জন্য অনেক গর্বের ও সম্মানের। তিনি বলেন, কোভিডের ভয়াবহ সময়ে বাংলাদেশে পাইওনিয়র (অগ্রদূত) প্রতিষ্ঠান ছিলো যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তখন প্রথম টেস্ট থেকে শুরু অনেক ধরণের অ্যাডভান্স সিকোয়েন্সিং হয়। বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে এসব কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয় তখন।
সূচনা বক্তব্যে দৈনিক সংবাদের জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহ বলেন, সাংবাদিকদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে বিভক্ত, আবার কেউবা জামায়াতের সাথে। পেশাদারিত্বের বড্ড অভাব। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে দৈনিক কল্যাণ ব্যতিক্রম। পত্রিকাটি কোন দলের লেজুড়বৃত্তি করে না। তাদের অহংকার পেশাদারিত্ব। তবে কল্যাণেরও লেজুড়বৃত্তি আছে-সেটি মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে। এখানে কোন আপোষ নেই। নেই পিছুটান। কল্যাণের সম্পাদকীয় নীতি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ও উদার।
অনুষ্ঠানের সভাপতি দৈনিক কল্যাণের প্রকাশক ও সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাম-উদ-দ্দৌলা বলেন, গুণীজনদের সম্মাননার এই ধারা অব্যাহত থাকবে। বিগত দিনগুলোর মতো এখনও নিরপেক্ষভাবে সংবাদ প্রকাশ করে যাবো। আপোষ করবো না। মুক্তিযুদ্ধের চেনতার ধারায় সমুন্নত থেকে সংবাদ প্রকাশ করে যাবো। অন্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধের নির্ভিক সাংবাদিকতা করবে দৈনিক কল্যাণ।
সম্মাননা অনুষ্ঠানে অনুভূতি জানাতে গিয়ে বাংলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত সাহিত্যিক হোসেন উদ্দীন হোসেন বলেন, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ আমার সেই শৈশব থেকেই। এক্ষেত্রে অনেকেই আমার প্রেরণার উৎস। একটা সময় দেশের প্রাচীন দৈনিক সংবাদেও কাজ করেছি। কিন্তু পরে সাহিত্য চর্চার জন্য পেশা ছেড়ে দিই। কারণ সংবাদ লেখায় কল্পণার কোন ব্যাপার নেই। সংবাদ হলো বাস্তব ঘটনা ও সেটি দেখা ও তা থেকে লেখা।
একুশে পদকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী যবিপ্রবি উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, নিজেকে যশোরের অচিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করি। যার স্বীকৃতি আজ এখানে পেয়েছি। তিনি বলেন, আজকের এই অনুষ্ঠানে আজ আমি যদি কয়েকজনের কথা না বলি তাহলে আজকের এই স্বীকৃতি ম্লান হয়ে যাবে। মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে কর্মরত শিক্ষকদের মধ্যে ড. ইকবাল কবীর জাহিদসহ অধিকাংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমার ছাত্র ছিলো। করোনার শুরুর দিকে নমুনা পরীক্ষার কাজে তাদের সাহসিকতার কথা উল্লেখ না করলে আমার আজকের এই সম্মাননা ম্লান হয়ে যাবে। কারণ একটা পর্যায়ে গিয়ে তারা সবাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তারপরও টেস্ট কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেন নি। সেই ভয়াবহ সময়ে তারা সবসময় পাশে থেকে সহযোগীতা করে গেছেন।
সম্মাননা অনুষ্ঠানে দুই গুণীজনকে উত্তোরীয় পরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি তাদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেয়া হয়। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পদকপ্রাপ্ত লেখক ও গবেষক হোসেন উদ্দীন হোসেনের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন। এমপি কাজী নাবিল আহমেদ একুশে পদকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্যের হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দৈনিক কল্যাণের প্রকাশক ও সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাম-উদ-দ্দৌলা গুণীজনদ্বয়কে উত্তোরীয় পরিয়ে দেন। অনুষ্ঠানে সাহিত্যিক ও গবেষক হোসেনউদ্দীনের জীবনী পাঠ করেন দৈনিক কল্যাণের নির্বাহী সম্পাদক শাহাদাত হোসেন কাবিল। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেনের জীবনী পাঠ করেন বিবর্তন যশোরের শিল্পী শাহরিন সুলতানা নিশী।
এছাড়া সম্মাননা অনুষ্ঠানে গুণী ব্যক্তিদ্বয়ের অংকনকৃত প্রতিকৃতি তুলে দেয়া হয় তাদের হাতে। দৈনিক কল্যাণের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এহসান-উদ-দৌলা মিথুন একুশে পদকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী ড. আনোয়ার হোসেনের হাতে তার প্রতিকৃতি তুলে দেন।
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এজাজ উদ্দীন টিপু বাংলা একাডেমি সাহিত্য পদকপ্রাপ্ত লেখক ও গবেষকের হাতের তার প্রতিকৃতি তুলে দেন।
উদীচী যশোরের শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় গুণীজন সম্মাননা অনুষ্ঠান। উত্তোরীয় পড়ানো ও ক্রেস্ট প্রদানের পর আলোচনা পর্ব শেষে ছিলো সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশনা করেন অমিতাভ দাস ভোলা, মামা রফিক ও জুনিথা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাংস্কৃতিক কর্মী শুভঙ্কর গুপ্ত। সম্মাননা অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করে ডেন্টিস্ট পয়েন্ট যশোর।