নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোরে রেললাইনের পাশ থেকে কিশোরীর মরদেহ উদ্ধারের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। সৎ পিতা ধর্ষণের পর চলন্ত ট্রেনে শ^াসরোধ করে হত্যা করে তরুণীকে ফেলে দেওয়া হয়। ধর্ষণের কথা গোপন রাখতেই পরিকল্পিতভাবে সৎপিতা এই হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছেন। ওই তরুণীকে হত্যার মূল আসামি সৎপিতা মিন্টু সরদারকে (৩৯) গ্রেপ্তারের পর মঙ্গলবার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। ওই তরুণীর নাম আঁখি খাতুন (১৪)। তার বাড়ি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার নাটিমা ইউনিয়নের দড়িয়াপুর গ্রামে। সে উপজেলার দাড়িয়াপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।
পুলিশ জানায়, সোমবার সকালে যশোর সদরের সাতমাইল ও মথুরাপুরের মাঝামাঝি স্থানে রেললাইনের পাশে অজ্ঞাত কিশোরীর লাশ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা। তার মুখম-ল রক্তাক্ত ছিল। খবর পেয়ে ডিবি পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। পরে পুলিশ সেখান থেকে মরদেহ উদ্ধার করে যশোর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ওই কিশোরীর ছবি দিযে পরিচয় শনাক্তের জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করা হয়। ফেসবুকে ছবি দেখে মহেশপুর থেকে এক ব্যক্তি নিহতকে শনাক্ত করতে পারেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন বলেন, তরুণীর পরিচয় পাওয়ার পরে সন্দেহভাজন হিসাবে তার সৎ বাবা মিন্টুকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি পুলিশকে হত্যার দায় স্বীকার করেন। মিন্টু পুলিশকে জানায়, গত ১৬ সেপ্টেম্বর শনিবার সৎ মেয়ে আঁখিকে চৌগাছার বলুহ দেওয়ানের মেলায় নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে আসে। মেলায় ঘুরাঘুরি শেষে রবিবার যশোর শহরের রেলস্টেশন এলাকার বৈকারী হোটেলে একটি কক্ষে উঠেন। সেখানে আঁখির ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করে সৎ বাবা মিন্টু। পরের দিন রাতে ট্রেন যোগে বাড়ি ফেরার সময় রাতে যশোর রেলস্টেশনের ঝোপঝাড়ের মধ্যে পুনরায় ধর্ষণ করে। এদিন রাত ১১ টার দিকে সীমান্ত এক্সপেস যোগে বাড়ি ফেরার পথে ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য চলন্ত ট্রেনে গলায় চাপ দিয়ে শ^াসরোধ করে হত্যা করে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় মিন্টু। এর পর তিনি বাড়িতে এসে তরুণীর দুই পায়ের একজোড়া নুপুর একটি সিগারেটের প্যাকেট ভর্তি করে তার বসতঘরের পাশে আবর্জনার মধ্যে পুতে রাখে। বাড়ি ফিরে পরিবারের লোকজনকে বলে মেয়ে হারিয়ে গেছে। একপর্যায়ে নিজেই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। পরিবারের লোকজন তাকে বাড়িতে বেঁধে রেখে পুলিশে খবর দেয়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, আঁখির মা নুরজাহান বেগমের সঙ্গে মিন্টুর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে সাতক্ষীরাতে বিয়ে হয়েছিলো। সেই দম্পতির সন্তান আঁখি। পরবর্তীতে সেই স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলে মিন্টুর সঙ্গে বিয়ে করেন নুরজাহান। এর আগে মিন্টুও দুই বিয়ে হয়েছিলো। এর মধ্যে এক স্ত্রী মিন্টুকে ছেড়ে চলে যায়; অন্যটি মারা যায়। মিন্টু ও নুরজাহানের সংসার একটি ছেলে সন্তানও রয়েছে। এই ঘটনায় আঁখির মা নুর জাহান বেগম বাদী হয়ে খুলনা রেলওয়ে থানাতে মামলা করছেন। মিন্টু দিনমজুরের কাজ করে। এদিকে, অভিযুক্ত আসামি মিন্টুকে যখন সংবাদ সম্মেলনে আনা হয়; তখন তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অনুতপ্ত হয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আমি জীবনে বড় ভুল করেছি। আমার মেয়েকে মেলাতে ঘুরানোর প্রলোভনে তার সঙ্গে খারাপ কাজ করেছি। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দুইবার ধর্ষণ করেছি। এমন ভুল জীবনে আর করবো না। আমার মতো এই ভুল যাতে কেউ না করে। এই কথা ভাবতে গেলে আমি কিছু খেতেও পারছি না। কিভাবে কি করে ফেললাম ভাবতে পারছি না। মারার সময় মেয়েটা কত কষ্ট পেয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক (ডিআইও-১ ডিএসবি) মামুন খান, জেলা ডিবি (ওসি) রুপন কুমার সরকার, ডিবি পুলিশের এস আই মফিজুল ইসলাম প্রমুখ।
এদিকে, মহেশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার শামীম উদ্দীন জানান, গত ১৭ সেপ্টেম্বর মহেশপুর থানায় স্বামীর বিরুদ্ধে মেয়েকে অপহরণের অভিযোগ দেয় আঁখির মা নুরজাহান। এই ঘটনায় প্রাথমিক তদন্ত করে থানা পুলিশ। পরের দিন যশোরে মরদেহ উদ্ধার হয়। পরবর্তীতে আঁখির পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। এ বিষয়ে মহেশপুর উপজেলার নাটিমা ইউনিয়নের দ্বারিয়াপুর গ্রামের ইউপি মেম্বার আব্দুল আজিজ বলেন, বাড়ির কাউকে না জানিয়ে আঁখিকে নিয়ে বাড়ি ছাড়ে মিন্টু সরদার। এরপর লোকজন তাদের খুঁজে না পেয়ে আমার কাছে আসে। আমি তাদের থানায় গিয়ে অভিযোগ করার পরামর্শ দিই। আঁখির মা তার দ্বিতীয় স্বামীর বিরুদ্ধে মেয়েকে অপহরণের অভিযোগ দেয়। একদিন পর মিন্টু সরদার একাই বাড়িতে ফিরে আসে। তখন পরিবারের লোকজনকে বলে মেয়ে হারিয়ে গেছে। মিন্টু নিজে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এ সময় পরিবারের লোকজন তাকে বেঁধে রেখে পুলিশে খবর দেয়।