নিজস্ব প্রতিবেদক
শীতের পড়ন্ত বিকেল, কিন্তু সূর্যের আলো তখনো স্নিগ্ধ, আবেশময়। যশোরের কাশিমপুর ইউনিয়নের ওসমানপুর গ্রামের সুবিশাল মাঠজুড়ে সেই আলো যেন এক সোনালী আভা ছড়াচ্ছিল। সে আলোয় মাঠের ধুলোও ঝলমল করছিল, যা উড়ছিল শত শত মানুষের উল্লাসের তালে তালে। সেই ধুলো শুধু মাটি নয়, যেন এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের স্মৃতি বয়ে আনছিল। এ শুধু খেলা নয়, এ যেন গ্রামবাংলার হারানো ঐতিহ্যের এক আবেগী প্রত্যাবর্তন।
শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) স্থানীয় যুবসমাজের আয়োজনেই বসেছিল ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি দৌড় প্রতিযোগিতা, যা শুধু প্রতিযোগিতা নয়, বরং গ্রামের শীতকালীন আনন্দের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় আশপাশের গ্রামের ১৪টি গরু ও তাদের সওয়ারিরা। প্রতিটি গাড়ির জন্য ধরা হয়েছিল ৫০০ টাকা টোকেন।
মাঠের পূর্ব প্রান্ত থেকে শুরু হয় চূড়ান্ত দৌড়। গরুর পায়ের খুরে উড়ে যায় ধুলো, চারপাশে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে উল্লাস করছে।
প্রথম পুরস্কার জিতেছেন বাঘারপাড়ার ওয়ালিদ হোসেন, দ্বিতীয় হয়েছেন নলডাঙ্গার শহিদুল ইসলাম এবং তৃতীয় হয়েছেন লেবুতলার সবেদালী মেম্বার। তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ফনিক্স বাইসাইকেল, ক্যাপ্টেন বাইসাইকেল ও ২৪ ইঞ্চি এলইডি টিভি। এছাড়া আরও ছয়জনকে দেওয়া হয়েছে সান্ত্বনা পুরস্কার।
প্রধান অতিথি হিসেবে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন কাশিমপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) বীর মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ার হোসেন। আয়োজক কমিটির সদস্য মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, “প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগে সালাম ও আমিন নামে দুজন কৃষক নিজেদের গরুর বড়াই নিয়ে তর্কে তর্কে প্রথম গরুর গাড়ির দৌড় করেছিলেন। সেই দিন থেকেই এটি হয়ে উঠেছে গ্রামের শীতকালীন আনন্দ উৎসব।”
প্রতিযোগিতার সঙ্গে মিলেমিশে বসে গেছে গ্রামের মেলা। মিষ্টি, পাঁপড়, বাদাম, চানাচুর, ফুচকা, পিঁয়াজু-সবই শিশু ও বড়দের আনন্দে মিশেছে। দলবেঁধে ছেলেমেয়েরা মাঠের এপার থেকে ওপারে ঘুরছে, গানের সুর আর চিৎকারে মুখরিত হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা।
মুজাহিদুল ইসলাম আরও জানান, গ্রামবাংলার গরুর গাড়ির সংখ্যা ক্রমশ কমছে। হারিয়ে যাওয়া এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মকে জানাতে প্রতিবছর আয়োজন করা হয় এই প্রতিযোগিতা। তাই শুধু প্রতিযোগিতা নয়, এটি হয়ে উঠেছে গ্রামের ঐতিহ্য, মিলনমেলা এবং আনন্দের এক জীবন্ত চিত্র।
ধানক্ষেতে ধুলো উড়ে, খুরের আঘাতের শব্দে, শিশুদের চিৎকার আর গ্রামের মানুষের উচ্ছ্বাসেÑওসমানপুরের মাঠে যেন বেঁচে উঠল গ্রামবাংলার শীতকালীন গল্প।
