অধ্যাপক আ ব ম ফারুক: ভাইরাসগুলো প্রকৃতির নিয়মেই ক্রমাগত তাদের রূপ পরিবর্তন করে। করোনাভাইরাসও তাই। আমরা এগুলোকে বলি মিউটেশন। এই মিউটেশনগুলো ক্রমাগতই ঘটলেও বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থায় এদের মিউটেশনের রূপ বিভিন্ন হতে পারে। যদি কোনো মিউটেশনের কারণে ভাইরাসটি কম ক্ষতিকর রূপ নেয় তাহলে সেটা নিয়ে আমরা খুব একটা মাথা ঘামাই না। কিন্তু যদি ক্ষতিকর দিকে রূপ নেয়, তখন আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তখন এগুলোকে বলে ‘ভেরিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’। যদি এটা বেশি ক্ষতিকর দিকে নিজের রূপান্তর ঘটায় তখন আমরা চিন্তিত হওয়ার বদলে জনস্বাস্থ্যের ওপর এর ক্ষতি বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যাকে বলে ‘ভেরিয়েন্ট অব কনসার্ন’।
২০১৯ সালের শেষের দিকে যখন কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাসটি আবিষ্কৃত হলো তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই ভাইরাসের হাজার হাজার মিউটেশন ঘটেছে। সবগুলোর খবর আমরা রাখি না, তার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু যখন কোনো কোনো রূপান্তর মারণরূপে ‘ভেরিয়েন্ট অব কনসার্ন’ হিসেবে হাজির হয় তখন বিশ্বব্যাপী মানুষের সাবধান হওয়া প্রয়োজন হয়। এভাবে বিভিন্ন দেশে জন্ম নেওয়া মূল করোনাভাইরাস ‘সার্স-কভ-২’ এবং এর বিভিন্ন ভেরিয়েন্টগুলো আজ পর্যন্ত সারাবিশ্বে কোটি কোটি মানুষকে আক্রান্ত করেছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। মূল করোনাভাইরাসে বিশ্বে যত মানুষ মারা গেছে তার চেয়ে অনেক বেশি মারা গেছে ভেরিয়েন্টগুলোতে। কিন্তু মানবকুল যাতে কোনো বিশেষ অঞ্চল বা বিশেষ দেশের ওপর ক্ষিপ্ত না হয়ে যায় সেজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এসব ভেরিয়েন্টকে কোনো অঞ্চল বা দেশ অনুযায়ী নামকরণের পরিবর্তে এগুলোকে আবিষ্কারের ক্রম অনুযায়ী আলফা, বিটা, গামা, ডেলটা, ডেলটাপ্লাস, ওমিক্রন ইত্যাদি নামকরণ করেছে।
এখন পর্যন্ত যেসব ভেরিয়েন্ট বেরিয়েছে তার মধ্যে মৃত্যু ঘটানোর শীর্ষে রয়েছে ডেলটা আর সংক্রমণ ঘটানোর ক্ষমতা বা ছোঁয়াচেপনার দিক থেকে শীর্ষে হলো ওমিক্রন, যেটি এখনো সারাবিশ্বে তার তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানের হিসেব অনুযায়ী এই ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝির পর থেকে সংক্রমণের হার সারা বিশ্বেই অনেক কমে আসবে। নতুন কোনো ভেরিয়েন্ট তা-ব শুরু না করলে আশা করা যায় বিশ্ব সাময়িকভাবে হলেও কিছুটা স্বস্তি পাবে। বাংলাদেশে ওমিক্রনের সংক্রমণের হার গত কয়েকদিনে কিছুটা থমকে গিয়ে কমে আসতে শুরু করেছে, যদিও মৃত্যুর সংখ্যা কমেনি। যারা মারা যাচ্ছেন তারা প্রায় সবাই টিকা নেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। মৃতদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক রয়েছেন যারা টিকা নেওয়া থাকলেও বয়স অনেক বেশি ছিল কিংবা তাদের অন্যান্য অসুখ ছিল।
তবে নতুন ভেরিয়েন্ট কিন্তু ইতোমধ্যেই বেরিয়েছে। নতুন এই ভেরিয়েন্ট একটি নয়, বরং কয়েকটি। যেমন গত নভেম্বরের শুরুতে ডেলটা ভেরিয়েন্টের একটা সাব-ভেরিয়েন্ট রাশিয়াতে বেরিয়েছিল, বিজ্ঞানীরা যার নাম দিয়েছিলেন ‘এওয়াই.৪.২’। তারা বলেছিলেন ডেলটার চাইতে নাকি এর সংক্রমণক্ষমতা বেশি ছিল, অর্থাৎ বেশি ছোঁয়াচে। কিন্তু তার মারণ ক্ষমতা বেশি কি না অর্থাৎ এর সংক্রমণের ফলে ডেলটার চাইতে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে কি না সে বিষয়ে তারা তখনো কিছু বলেননি। শুধু রাশিয়াতেই নয়, যুক্তরাজ্যেও নাকি এই সাব-ভেরিয়েন্টটি পাওয়া গিয়েছিল। এ রকম আরও এসেছে। যেমন গত মাসে ইসরায়েলে ‘ফ্লুরোনা’, ফ্রান্সে ‘ইহো’, সাইপ্রাসে ‘ডেলটাক্রন’। তারও আগে ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়াতে ‘ইক’, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে ‘ল্যামড’, কলাম্বিয়াতে ‘মিউ’ ইত্যাদি।
তবে ডেলটার পর সারাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি সমস্যা করেছে নভেম্বরের শেষদিকে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আফ্রিকার দক্ষিণাংশের বেশ কিছু দেশে যে ভেরিয়েন্টটির জন্ম হয় যার নাম রাখা হয় ‘ওমিক্রন’। আত্মপ্রকাশের কয়েকদিনের মধ্যেই এটি ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশে খুবই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও একে ভেরিয়েন্ট অব কনসার্ন বলে ঘোষণা করে এর সম্পর্কে কড়া সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলে যে এতে মৃত্যুহার কম হলেও এটি হবে এ পর্যন্ত পাওয়া করোনার ভেরিয়েন্টগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সংক্রামক। এরপর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন যে, এই ওমিক্রন ভেরিয়েন্টটি ডেলটা ভেরিয়েন্টের চাইতে তিনগুণ বেশি সংক্রামক এবং মৃত্যুহার কম হলেও বয়স্ক রোগীদের জন্য বেশি বিপদজনক হওয়ার আশংকা রয়েছে, বিশেষ করে যাদের কো-মর্বিডিটি অর্থাৎ যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কিংবা যাদের হৃদযন্ত্র, বৃক্ক, যকৃত, ফুসফুস ইত্যাদির সমস্যা রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের সবগুলো আশংকা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে ওমিক্রন তার সীমাহীন তা-ব চালালো এবং গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি এই দুইমাসে ডেলটার চাইতেও বেশি মানুষকে আক্রান্ত করল। ওমিক্রনের আরেকটা মারাত্মক আশংকার দিক হলো এই সত্য যে এটি তরুণ বয়সের, এমনকি ছোট বাচ্চাদেরও আক্রান্ত করতে লাগলো। এগারো বছরের বেশি বয়সীদের জন্য ফাইজারের সাম্প্রতিক টিকা দেওয়া গেলেও এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোথাও শিশুদের জন্য করোনার কোনো টিকা নেই। এই মাসের শেষাংশে কিংবা আগামী মাস অর্থাৎ মার্চের শুরু থেকে আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ফাইজারের টিকা বাজারে পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত পরীক্ষায় এই টিকার কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে প্রায় ৯১ শতাংশ, অর্থাৎ খুবই কার্যকর। কিন্তু তারপরেও ৫ বছরের কম বয়সী শিশুরা আগের মতোই সুরক্ষাহীন থেকে যাবে বলেই আশংকা রয়েছে।
এর মধ্যেই ওমিক্রন থেকে তার একটি সাব-টাইপ বেরিয়েছে। ওমিক্রনের বৈজ্ঞানিক নামকরণ ছিল ‘বিএ.১’। এখান থেকে উদ্ভুত এই সাব-টাইপের নাম হলো ‘বিএ.২’। আপাতত একে ‘নিওকোভ’ নামে ডাকা হচ্ছে। এর জন্ম কিছু বিজ্ঞানীর মতে আগের মতোই দক্ষিণ আফ্রিকায়, কারো কারো মতে ভারতে, আবার কারো মতে এর প্রথম আত্মপ্রকাশ হয়েছে ফিলিপাইনে। জন্ম যেখানেই হোক, মূল বিষয়টি হলো এটি অত্যন্ত সংক্রামক, ওমিক্রনের চাইতেও দেড়গুণ বেশি। তবে এর মৃত্যু ঘটানোর হার বিষয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। বিশ্বব্যাপী গবেষণা চলছে, তবে বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন যে নিওকোভের মৃত্যুহার ওমিক্রনের চাইতে খুব বেশি নাও হতে পারে।
যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, সুইডেন, ভারত, ফ্রান্স ও ডেনমার্কে এই নতুন ওমিক্রন সাব-টাইপ ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে গেছে। এই নিওকোভ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা চলছে, তবে সবচেয়ে বেশি কাজ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনে। তারা এ পর্যন্ত পাওয়া তাদের গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে বলেছে যে, নিওকোভের কারণে মহামারি আরও কিছুটা দীর্ঘায়িত হতে পারে, তবে এটা বিশ্বে ওমিক্রনের মতো বিপর্যয় হয়তো সৃষ্টি করতে পারবে না।
নিওকোভ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরাও কিছুটা আশারবাণী শুনিয়েছেন যে, এখন পর্যন্ত যে টিকাগুলো হাতে আছে সেগুলোর ১ম ও ২য় ডোজ পরবর্তী বুস্টার ডোজ নেওয়ার পর নিওকোভের বিরুদ্ধে প্রায় ৭০ শতাংশ কার্যকারিতা পাওয়া যাবে, যেখানে ওমিক্রনের বিরুদ্ধে ৬৩ শতাংশের বেশি কার্যকারিতা পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ নিওকোভ ওমিক্রনের চাইতে বেশি ছোঁয়াচে হলেও টিকাগুলোর বিরুদ্ধে এটি ওমিক্রনের চাইতে কিছুটা দুর্বল। অনেক আশংকার মাঝে এই তথ্যটি তাই কিছুটা স্বস্তির।
এই নিয়ে ডেনমার্ক থেকে পাওয়া খবরটা হয়তো আরেকটু আশা জাগাবে যে, করোনা টিকার দুই বা তিনটি ডোজ নেওয়া থাকলে নিওকোভের সংক্রমণ ক্ষমতা ওমিক্রনের সমান বলে দেখা গেছে। তাছাড়া সেখানে নিওকোভের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে হাসপাতালে কোভিড রোগী ভর্তির হার বাড়েনি, অর্থাৎ আগে ওমিক্রনের বেলায় যে হারে ভর্তি হতো এখনো তাই আছে।
নতুন এই নিওকোভ সংক্রমণ ক্ষমতার দিক থেকে ওমিক্রনের চাইতেও বেশি মারাত্মক হলেও এটি ওমিক্রনের চাইতেও হয়তো বেশি বিপর্যয়ের হবে না, বিজ্ঞানীদের এই আশাবাদের পেছনে কারণগুলো হলো ইতোমধ্যে অধিক সংখ্যক মানুষ টিকা নেওয়া ও মাস্ক পরার ব্যাপারে অধিকতর সচেতন হচ্ছে।
বাংলাদেশে আমরা দেখেছি যে এখানে দৈনিক সংক্রমণের ও মৃত্যুর হার অনেক কমে ১ শতাংশেরও নিচে আসার পর অল্পকিছু সত্যিকার সচেতন মানুষ ছাড়া দেশের অধিকাংশ মানুষ মাস্ক পরা বন্ধ করল। একসময় আমাদের সরকার টাকা হাতে নিয়ে ঘুরলেও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যথেষ্ট টিকা সংগ্রহ করতে পারছিল না। কিন্তু বেশ কয়েকমাস আগে থেকে আমাদের দেশের টিকা রাখার সব গোডাউনে টিকার মজুদ উপচে পড়লেও মানুষজন টিকা নিতে আগ্রহী হচ্ছিল না। ফলে মাস্ক না পরা, টিকা না নেওয়া, হাত পরিষ্কার না রাখা বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্বাস্থ্য বিধিসমূহ মেনে না চলার কারণে করোনা আক্রান্তের ও মৃত্যুর হার আবার অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়ে গেল। এই রকম একটা ব্যাপার ঘটবে তা আমরা আগে থেকেই আশংকা করছিলাম। পত্রপত্রিকায় ও টেলিভিশনে আমরা বলছিলামও। কিন্তু মানুষ শোনেনি। তার বিষময় ফল আমরা এখন পাচ্ছি। নতুন সাব-ভেরিয়েন্ট নিওকোভ পৃথিবীর অনেক দেশের মতো ভারতেও ছড়াচ্ছে মাসখানেক আগে থেকেই। এই নিওকোভ বাংলাদেশেও এসেছে এবং মানুষকে আক্রান্ত করতে শুরু করেছে। আমার বিশ্বাস যেহেতু নিওকোভের সংক্রমণ ক্ষমতা ওমিক্রনের চাইতে বেশি এবং আমাদের চারপাশের দেশগুলোতে এর বিস্তার ইতোমধ্যেই ঘটেছে, তাই এখনকার বাংলাদেশে যত মানুষ এখন কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছে তার অধিকাংশই নিশ্চয়ই নিওকোভের কারণেই হচ্ছে।
তবে এখনো আমাদের দেশের মানুষ যদি সঠিক নিয়মে অর্থাৎ শুধু থুতনিকে না ঢেকে নাক ও মুখকে ভালোভাবে ঢেকে মাস্ক পরা শুরু করে, যদি টিকা নেওয়ার ব্যাপারে গণ-আগ্রহ তৈরি হয়, যদি ভিড়ে না গিয়ে মানুষ সামাজিক দূরত্ব মেনে চলে, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ আপাতত কিছুদিন এড়িয়ে চলে, বিয়ে-জন্মদিন-জেয়াফত-শ্রাদ্ধ ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠান যদি আপাতত বন্ধ রাখে, মসজিদ-মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডায় যদি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ইবাদত-প্রার্থনা করা হয়, রেস্টুরেন্টগুলোতে মানুষের একত্র সমাগম যদি সত্যিই অর্ধেকে আনা যায়, বড়লোক এলাকার রেস্টুরেন্টগুলোতে মাঝরাত পর্যন্ত যে আড্ডাগুলো চলে তা বন্ধ করা যায়, মানুষ যদি ঘনঘন হাত ধোয়, যদি অপরিষ্কার হাতে মুখ-নাক-চোখ স্পর্শ না করে, টাকা বা কাগজ গোনার সময় আঙ্গুল জিহ্বা থেকে ভিজিয়ে না নেয় এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য বিধিগুলো মেনে চলে তাহলে ওমিক্রনের আক্রমণের ঢেউ যেমন স্থিমিত হবে এবং যা ইতোমধ্যে হয়েছেও, তেমনি নতুন সাব-ভেরিয়েন্ট নিওকোভের আক্রমণও ঠেকানো সম্ভব হবে। মূল ভূমিকাটা তাই জনগণকেই নিতে হবে। জনগণকেই সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কী চায়।
লেখক-পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়