-
দাবদাহে পুড়ছে খুলনা বিভাগ
-
বৃষ্টি হবে কবে?
-
আরও তাপপ্রবাহ আসছে
-
এত তাপপ্রবাহের কারণ কী?
কল্যাণ ডেস্ক
“এবারের মতো গরম আমি আগে দেখিনি। রোদে গেলে মনে হচ্ছে গায়ের চামড়া পুড়ে যাচ্ছে”, দৈনিক কল্যাণকে বলছিলেন যশোরের একজন রিক্সাচালক সাহেব আলী। ৬০ বয়সী সাহেব আলী ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রিক্সা চালাচ্ছেন। গরমের কারণে তার দৈনন্দিন আয় প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানাচ্ছিলেন।
“আয় থাকবে কী করে? খ্যাপ টানতে গেলেই গলা-বুক শুকায়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। পানি খাওয়ার পরও মনে হচ্ছে তেষ্টা মিটতেছে না”, বলেন সাহেব আলী।
৪৫টির বেশি জেলার উপর দিয়ে এখন তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। একইসাথে, দিনের গড় তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ফলে তীব্র গরম অনুভূত হওয়ায় সারা দেশেই জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এ অবস্থার মধ্যেই সোমবার আবারও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ বা তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তীব্র গরমের কারণে ইতোমধ্যেই স্কুল-কলেজে সাত দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
পাশাপাশি গরমে হিট স্ট্রোকসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় বেশ কয়েকজনের ম্তৃ্যু হয়েছে। কিন্তু এবছর এত গরম পড়ার কারণ কী? বর্তমানে যে তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে, সেটিই-বা কতদিন চলবে?
দাবদাহে পুড়ছে খুলনা বিভাগ :
দাবদাহে পুড়ছে খুলনা বিভাগ। বৈশাখের শুরু থেকেই বাড়তে থাকা তাপমাত্রা গত কয়েকদিন আরও বেড়েছে। গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঘর থেকে বের হলেই গরম বাতাস শরীরে জ্বালা ধরাচ্ছে। গতকাল সোমবার (২২ এপ্রিল) খুলনা বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোর ও চুয়াডাঙ্গায়। আর খুলনায় ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ জানান, সোমবার খুলনায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া যশোর জেলায় ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি, চুয়াডাঙ্গায় ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি, সাতক্ষীরায় ৩৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি, মোংলায় ৪০ ডিগ্রি, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ৪০ ডিগ্রি এবং পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে তীব্র গরমে নাকাল হয়ে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষের জনজীবন। জীবিকার তাগিদে এমন খরতাপের মধ্যেও ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে তাদের। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অন্যরা কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
প্রচণ্ড দাবদাহে বিপাকে পড়েছে যশোরের খেটে খাওয়া মানুষেরা। প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
নতুন ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি :
তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা না থাকায় সারা দেশে আবারও তিন দিনের জন্য ‘হিট অ্যালার্ট’ বা তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
চলতি মাসে এ নিয়ে টানা তৃতীয় দফায় ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করা হলো। এই সময়ে সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানানো হয়েছে। “এই সময় বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য থাকবে। ফলে গরমের অস্বস্তি কিছুটা বাড়তে পারে”, বলেন আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই দেশে কিছু জেলায় তাপপ্রবাহ বইতে শুরু করে। এরপর গত দুই সপ্তাহে তাপপ্রবাহ প্রায় সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলার উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই যশোরে চলতি বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
এছাড়া রোববার চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
দেশে সাধারণত কোনও স্থানের তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে সেখানে সতর্কবার্তা জারি করা হয়।
“কোনও বিশাল এলাকা জুড়ে যখন তাপপ্রবাহ হয়, তখন এরকম সতর্কবার্তা দেওয়া হয়,” বলেন আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক।
এক্ষেত্রে বাতাসে তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম হলে, সেটিকে মৃদু তাপপ্রবাহ ধরে থাকেন আবহাওয়াবিদরা। এছাড়া তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে মাঝারি এবং ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে, সেটিকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়ে থাকে।
আর তাপমাত্রা যদি ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে যায়, তখন তাকে বলা হয় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ। গত দুই সপ্তাহে যশোর এবং চুয়াডাঙ্গা জেলায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা গেছে।
আর বর্তমানে পাবনা ও চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আর রাজশাহী, টাঙ্গাইল, যশোর এবং কুষ্টিয়ায় তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে বলে জানানো হয়েছে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই এপ্রিল মাসে গড়ে সাধারণত দুই-তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ এবং এক থেকে দু’টি তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়।
কিন্তু এবছর তীব্র তাপপ্রবাহ অনুভূত হওয়ায় ইতোমধ্যেই তিনটি হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেও নতুন হিট এলার্ট জারি করতে হতে পারে বলে ধারণা করছেন আবহাওয়াবিদরা।
বৃষ্টি হবে কবে? :
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে বাংলাদেশে এবছর এপ্রিলে গড় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে।
“বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কম হচ্ছে। ফলে গরম থেকেই যাচ্ছে”, বলেন আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান।
তিনি আরও বলেন, “ভারি বৃষ্টিপাত হলেই গরম কেটে যাবে।”
কিন্তু কবে নাগাদ সেই ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হতে পারে?
“কাছাকাছি সময়ের মধ্যে বড় ধরনের বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না”, বলেন আবহাওয়াবিদ শাহ আলম। মূলত : বঙ্গোপসাগর থেকে মৌসুমী বায়ু না আসায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে না বলে জানান তিনি। “এ বছর মৌসুমী বায়ু আসতে দেরি হচ্ছে। কাজেই ভারি বৃষ্টিপাতের জন্য আমাদেরকে জুন মাস পর্যন্তও অপেক্ষা করা লাগতে পারে”, বলেন শাহ আলম। তবে আগামী শুক্রবার নাগাদ দেশের কোথাও কোথাও হালকা দমকা হাওয়া ও বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে পরিমাণ কম হওয়ায় সেই বৃষ্টিপাত গরম কমানোর ক্ষেত্রে খুব একটা কাজে আসবে না বলেও জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
আরও তাপপ্রবাহ আসছে :
বৃষ্টিপাত শুরু হতে দেরি হওয়ায় এবছর তাপপ্রবাহ সহসাই থামবে না বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
“সামনে আরও তাপপ্রবাহ আসছে এবং পুরো মে মাসজুড়ে সেটি চলতেই থাকবে”, বলেন আবহাওয়াবিদ শাহ আলম। এছাড়া মৌসুমী বায়ু আসতে দেরি হওয়ায় এবছরের তাপপ্রবাহের স্থায়িত্ব বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা। “এমনকি তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তিকাল আগের বছরগুলোকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে”, বলেন শাহ আলম। দেশে এর আগে তাপপ্রবাহ একটানা সর্বোচ্চ ২৩ দিন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হওয়ারও রেকর্ড রয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
তবে তাপপ্রবাহ দীর্ঘায়িত হলে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে বলে জানাচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা।
এত তাপপ্রবাহের কারণ কী? :
দেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের গত কয়েকদিনের পূর্বাভাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে এখন বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করছে।
এর কারণ হিসেবে আবহাওয়াবিদরা জানান, বাংলাদেশের ওই অঞ্চলের দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যের অবস্থান। কিন্তু এইসব প্রদেশের তাপমাত্রা অনেক বেশি। এসব জায়গায় বছরের এই সময়ে তাপমাত্রা ৪২ থেকে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাঝে ওঠানামা করে।
ড. মল্লিক বলেন যে গত বছর ভারতের ওইসব অঞ্চলের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। “যেহেতু ওগুলো উত্তপ্ত অঞ্চল, তাই ওখানকার গরম বাতাস চুয়াডাঙ্গা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং তা আমাদের তাপমাত্রাকে গরম করে দেয়।”
এই আন্তঃমহাদেশীয় বাতাসের চলাচল ও স্থানীয় পর্যায়েও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে দেশব্যাপী এবছর তাপপ্রবাহ তুলনামূলক বেশি থাকতে পারে বলে মনে করছেন ড. মল্লিক।
“বিগত বছরের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে ২০২৪ সাল উত্তপ্ত বছর হিসেবে যাবে। আমরা এ বছর তাপপ্রবাহের দিন এবং হার বেশি পেতে যাচ্ছি”, বলেন তিনি। “এর কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। বাংলাদেশের তাপমাত্রার উর্ধ্বগতিতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ছোঁয়া লেগেছে”, মন্তব্য ড. মল্লিকের।
এছাড়া বনভূমির পরিমাণ কমে যাওয়া, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াএবং শিল্পায়ন ও নগরায়ন বেড়ে যাওয়ার কারণেও সার্বিকভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা।