এম আর খায়রুল উমাম: ‘স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে দেখো বরং স্বপ্ন সেটাই যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।’ বাংলাদেশের মানুষকে সেই ঘুমাতে না দেয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন আমরাও পারি। শত সহ¯্র বাধাঁ অতিক্রম করে নন্দিত বাস্তবতায় পদ্মা সেতু আজ স্বপ্নের নয়, গর্বের পদ্মা সেতু, অহংকারের পদ্মা সেতু। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হলে যারা অর্থায়নে আগ্রহী হয় তাদের দুর্ণীতির অভিযোগে সরে দাঁড়ানোর ফলে নিজস্ব অর্থায়নে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রীর মানসিক শক্তি জাতিকে আগামী দিনের জন্য যে কোনো উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে এগিয়ে নিতে সাহসী করে তুলবে এ বিশ্বাস রাখি।
পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সাড়ে ৩ কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সোপান হিসেবে অবদান রাখবে। এ অঞ্চলের মানুষ জাতীয় দারিদ্র বিবেচনায় পিছিয়ে থাকায় পদ্মা সেতু আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হবে। বঙ্গবন্ধু সেতু যেমন উত্তরাঞ্চলের মানুষকে জাতীয় অগ্রগতির ধারায় যুক্ত করেছে, ঠিক তেমনি পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য একই ভূমিকা রাখবে। এ অঞ্চলের কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ ঘটবে তাতে কোনো দ্বিমত নেই। সাধারণ মানুষের দূর্ভাগ্যের অবসান ঘটিয়ে জীবনমান উন্নয়নে সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে আসছে পদ্মা সেতু। যদিও ২৫ জুন সড়ক যোগাযোগ চালু হলেও রেল যোগাযোগের জন্য ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সড়কের পাশাপাশি রেল যোগাযোগ শুরু হলে এ অঞ্চলের মানুষের প্রত্যাশা পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে।
পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে রাজধানীর দূরত্ব কমবে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রেলওয়ে সূত্রে জানা যায় বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে যশোরে রেল যোগাযোগে ৪৭৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয় আর পদ্মা সেতু দিয়ে তা হবে মাত্র ১৬৫ কিলোমিটার। পদ্মা সেতুর কারণে রেল পথ কমবে ৩০৮ কিলোমিটার যা মোট পথের প্রায় ৬৫ শতাংশ। অনুরূপভাবে সড়ক পথে কমবে বর্তমানের প্রায় ৪০ শতাংশ। রাজধানীর সাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর দূরত্ব কমায় দেশের অর্থনীতিতে তার ব্যাপক প্রভাব পড়বে। দেশের সবকিছু ঢাকা কেন্দ্রীক হওয়ায় কারণে অকারণে জেলার মানুষকে রাজধানীতে ছুটতে হয়। দূরত্ব কমার ফলে মানুষের যোগাযোগ সহজ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর যশোরের বেনাপোলে। এই বন্দর দিয়ে স্থলপথে সবচেয়ে বেশি আমদানি-রফতানি হয়ে থাকে। কাষ্টম হাউসের সূত্রে জানা যায় গত ৫ বছরে ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে ৮৮ লাখ ৮৯ হাজার ৮১১ মেট্রিক টন আর রফতানি হয়েছে ১৮ লাখ ৭২ হাজার ২১০ মেট্রিক টন পণ্য। এই বিশাল পরিমাণের পণ্য আনা নেয়ার ক্ষেত্রে দূরত্ব কমার কারণে পরিবহন ব্যয় কমবে যা পণ্যের মূল্য কমাতে সহায়ক হবে। শুধু বেনাপোল স্থলবন্দর নয়, ভোমরা ও দর্শনা স্থলবন্দর, মোংলা ও পায়রা নৌবন্দর, বিভাগীয় শহর খুলনা সর্বত্র দূরত্ব কমবে। এই দূরত্ব ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে, পণ্য পরিবহনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
যশোরবাসী দীর্ঘদিন অভয়নগর উপজেলা নওয়াপাড়ায় নৌবন্দর করার দাবী জানিয়ে আসছে। ২০০৮ সালে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও স্থানীয় কিছু ব্যক্তির বিরোধিতায় নৌবন্দর প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি। ব্যক্তিস্বার্থের কাছে জাতীয় স্বার্থ পরাজিত হয়েছে। প্রশাসন সেদিন আজকের প্রধানমন্ত্রীর মতো অদম্য মানসিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় রেখেছিল। তা নাহলে আজ নওয়াপাড়া নৌবন্দর সচল দেখা যেতো পাশাপাশি কনটেনার টার্মিনাল স্থাপন করলে তা জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতো। এই নৌবন্দরও অন্যান্য বন্দরের মতো পদ্মা সেতুর সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারতো।
পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ সুলভ ও সহজ হয়ে যাওয়ার কারণে যশোরে উৎপাদিত সবজি, রেণুপোনা, ফুল বাজারজাতকরণের পথ আরো উন্মুক্ত হবে। যশোরের গদখালিকে ফুলের রাজধানী বলা হয়ে থাকে। ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলার গ্রামের পর গ্রাম মানুষ সারাবছর দেশ-বিদেশের ফুল চায় করে। বিশেষ কোনো দিনে এখানে ৪/৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়ে থাকে। এখনও পর্যন্ত ফুল পরিবহনের পাশাপাশি সংরক্ষণ সমস্যার জন্য কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। পদ্মা সেতু এই কৃষকদের জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক হবে। যশোরের সদর উপজেলার চাঁচড়া রেনু পোনা উৎপাদনের আকর। দেশের চাহিদার প্রায় ৮০ ভাগই এ অঞ্চল থেকে সারাদেশে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। রেণু পোনা পরিবহনে উচ্চ কারিগরি ব্যবস্থার প্রয়োজন যা আমাদের দেশে পাওয়া কষ্টসাধ্য। স্থানীয় উৎপাদকরা নিজেদের মেধা আর অভিজ্ঞতা দিয়ে যে পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে নিয়েছেন তা খুব বিজ্ঞানসম্মত বলা যাবে না। পদ্মা সেতু রেণু পোনা উৎপাদকদের জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক হবে। যশোরের সবজি উৎপাদকদের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য।
যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়াকে কেন্দ্র করে বেশকিছু বৃহৎ শিল্প গড়ে ওঠেছে। যদিও সরকারি বৃহৎ শিল্পগুলো জবাবদিহিতাহীন অব্যবস্থাপনার কারণে পথ হারিয়ে ফেলেছে। তবে বেসরকারি উদ্যোগ এখনও চলমান। পদ্মা সেতুর কারণে বৃহৎ শিল্পের প্রসার ঘটার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আগামীতে বৃহৎ শিল্পের পাশাপাশি কুটির শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এমনকি গার্মেন্টস শিল্পও দূরত্ব বিবেচনায় করা সম্ভব। শিল্প বিকাশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে যা এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হবে এবং মূল অর্থনৈতিক ধারার সাথে মানুষ সম্পৃক্ত হবে। তবে পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ সুফল পেতে কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন আসবে। সরকার বৃহৎ শিল্পকে উন্নয়নের নীতিমালার অংশ করবে তবেই এলাকার মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হবে।
পদ্মা সেতুর সবচাইতে পজেটিভ দিক হচ্ছে তার দৈর্ঘ। নদীকে ঠিক রাখতে ৬.৬৫ কিলোমিটার সেতু করা হয়েছে। দেশের সর্বত্র সেতু নির্মাণে নদী বিবেচিত হয় না। বঙ্গবন্ধু সেতুর দিকে তাকালে এই বিষয়টি ভালোভাবেই দেখা যাবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নদীকে/শাসন করে এনে প্রয়োজনের তুলনায় ছোট সেতু নির্মাণ করা হয়ে থাকে। ছোট বড় সব সেতুর ক্ষেত্রে সামান্য নজর দিলেই এটা যে কেউ বুঝতে পারবে। আমাদের পেশাজীবীদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা এবং দেশপ্রেম ও পরিবেশ বিবেচনা না থাকার কারণে প্রয়োজনের তুলনায় ছোট সেতু নির্মাণ করা হয়। পদ্মা সেতু ব্যতিক্রম। সে কারণে যমুনার চাইতে পদ্মায় বড় সেতু। যদিও প্রাক্কলনের তিনগুণ ব্যয় হয়েছে এবং তার দায় পেশাজীবীদের নিতে হবে। জবাবদিহিতাহীন হওয়ার কারণে দেশের একটাও প্রকল্প নেই যেটা প্রাক্কলিত অর্থ ও সময়ে শেষ হয়েছে। দেশের মেধাবী সন্তানরা পেশাজীবী হয়ে সাধারণ মানুষকে নিজেদের মেধার দোহাই দিয়ে একটা যুক্তি দিলেই তাদের কাছে তা যে গ্রহণযোগ্য হবে তা মনে করার কারণ নেই। তবে এ পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতুর ব্যয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই।
পদ্মা সেতু নির্মাণে দূর্ণীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকারাই শুধু বাঁধা সৃষ্টি করেনি, স্থান নির্বাচন নিয়ে যশোর অচল করার ঘোষণা দিয়ে কিছু মানুষকে আন্দোলন করতে দেখা গিয়েছে। আজ আবার সেই আন্দোলনকারীদের অনেককেই জয় বাংলা বলে আনন্দ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে।
পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষদের জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক। ২৫ জুন আনন্দের দিন। তারপরও দ্বিতীয় পদ্মা সেতু পাটুরিয়ায় নির্মাণের দাবী এখনো চলমান। এখনো এই দ্বিতীয় সেতু নির্মাণের দাবীর যৌক্তিকতা পাওয়া যায় না। বরং মনে হয় পদ্মা সেতুর কারণে সড়ক পথে যারা রাজধানীতে যাতায়াত করেন তারা যানজটে নাকাল না হলে যাত্রাপথে একটা সুন্দর আনন্দদায়ক নৌবিহার থেকে বঞ্চিত হবে।
( লেখক; আইইডির সাবেক সভাপতি)