আবদুল কাদের
করোনার মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে যশোর বিসিক শিল্প নগরীতে। নানা সঙ্কটেও গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৫৬ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হয়েছে যশোর বিসিকে। এরমধ্যে বিদেশে রফতানি করা হয়েছে ১৯০ কোটি টাকার পণ্য। আর দেশিয় বাজারে বিক্রি হয়েছে ৪৬৬ কোটি টাকার পণ্য। গত ২০১৯-২০, ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে বিসিকে পণ্য উৎপাদনে ধস দেখা দিয়েছিল। ওই তিন বছরে গড়ে ৪শ কোটি টাকার মতো পণ্য উৎপাদন হয়েছিল।
যশোর বিসিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যশোর বিসিক শিল্প নগরীতে ৬৮৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকার পণ্য উৎপাদন হয়েছিল। এর মধ্যে স্থানীয় বাজারে ৪৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি এবং রফতানি করা হয়েছে ২৪৮ কোটি টাকার পণ্য।
এদিকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিসিক শিল্পনগরী যশোরে তেমন উন্নয়ন হয়নি। অবহেলিত থেকে গেছে যশোর বিসিক। কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর সার্ভিস চার্জ নিলেও উন্নযনে কোন নজরই দিচ্ছেনা। এখানে দ্বিতীয় বিসিক শিল্প নগরী স্থাপনের উদ্যোগটিও থমকে আছে বছরের পর বছর ধরে। সেই সাথে আছে নিরাপত্তার ঝুঁকি। আর এসব কারণে স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে গত বছর রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণ করেছে বিসিক কর্তৃপক্ষ।
যশোর শহরের পাশেই ঝুমঝুমপুরে ৫০ একর জমির উপর ১৯৬২ সালে গড়ে উঠে এ শিল্পনগরী। বিসিক কর্মকর্তারা জানান, এই শিল্পনগরীতে মোট ১২২টি ইউনিট চালু রয়েছে। এসব শিল্প কারখানায় ৬ হাজার ৯১৮ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। নারী শ্রমিক রয়েছে ২ হাজার ৯৮৬ জন।
এখানকার শিল্প উদ্যোক্তারা জানান, যশোর বিসিক শিল্পনগরী থেকে সরকার নানাভাবে লাভবান হলেও এর উন্নয়নে কর্তৃপক্ষের কোন দৃষ্টিই নেই। এখানে কোন পুলিশ ক্যাম্প নেই। নেই সড়ক বাতি। সন্ধ্যার পর পুরো বিসিক শিল্প এলাকা ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি নিত্যকার ঘটনা। এ শিল্পনগরীতে ৩ কিলোমিটার পাকা রাস্তা এবং প্রায় ৬ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে, যার মধ্যে সংস্কার না হওয়ায় বেশিরভাগ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে ড্রেনগুলো। প্রত্যেকটি শিল্প-কলকারখানার জন্য পানি একটি অপরিহার্য উপাদান। যশোর বিসিক শিল্পনগরীর জন্য ১৯৬২ সালে মাত্র ২৫টি ইউনিটের জন্য পানির পাম্প স্থাপন করা হয়। অথচ ইউনিটের সংখ্যা এখন ১২২-এ পৌঁছালেও সেই অর্ধশত বছরের পুরনো পাম্প দিয়েই এখনও কাজ চালানো হচ্ছে। তাও আবার দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় পানি সরবরাহ ঠিকমতো হয় না।
এ বিষয়ে শিল্প উদ্যোক্তা এনায়েত ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্তাধিকারী আকতার হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যশোর বিসিক নানা সমস্যায় জর্জরিত। এখানকার অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। সেই সাথে আছে পানি, বিদ্যুৎ, রাস্তার সমস্যা। এসব সমস্যার সমাধান হলে এখানে আরও বিনিয়োগ গড়ে ওঠত। প্রতিবছর সার্ভিস চার্জ নিলেও ন্যূনতম সেবা দিচ্ছেনা তারা। তারমতে করোনার পর দুই বছর চরম মন্দাভাব ছিল। সেটা পুরোপুরি না গেলেও কাটতে শুরু করেছে।
বিসিকের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এমইউ সিইএ ফুডসের স্বত্ত্বাধিকারী শ্যামল দাস জানান, আমরা ইউনিয়ন পরিষদকে কর দিচ্ছি, আবার বিসিক নিচ্ছে সার্ভিস চার্জ। নিয়ম হলো এই সার্ভিস চার্জ নিয়ে তারা আমাদেরকে সেবা দেবে। কিন্তু বিসিক থেকে আমরা কোন সুবিধা পায়না। এখানকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। নিজেদের অর্থে ড্রেনেজ পরিস্কার করাতে হয়। নেই কোন সীমানা প্রাচীর ও মেইন গেইট। একই সাথে এখানে বৈদ্যুদিক ফিডারও নেই। তিনি বলেন, করোনার মন্দাভাব কাটতে শুরু করেছে। আমরা ১৯টি দেশে বর্তমানে হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করছি। করোনার সময় মাত্র ৬-৭টি দেশে রফতানি করতাম খুব সীমিত।
যশোর বিসিক শিল্পনগরী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ মোস্তফা আলী বলেন, এখন গরম মৌসুম চলছে। কোন ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগলে তা নেভানোর জন্য এখানে পানি নেই। ৬২ সালে স্থাপন করা পানি সরবরাহ লাইন পুরোপুরি অকেজো হয়ে আছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যতটুকু পানি সাথে করে নিয়ে আসবে, সেটুকুই কেবল ব্যবহার করতে পারবে, বাড়তি পানি বিসিক শিল্পনগরী থেকে পাবে না।
তিনি বলেন, নারী-পুরুষ মিলিয়ে সাড়ে প্রায় ৭ হাজারেরও বেশি শ্রমিক এখানে কাজ করে। রাত-দিন মিলিয়ে ৩ শিফটে কাজ হয়। রাত ১০ টার দিকে যেসব নারী শ্রমিক বাড়ি ফেরে ও কাজে যোগদান করতে আসে, তাদের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মহিলা শ্রমিকদের শ্লীলতাহানীর ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। এসব ব্যাপারে বারবার কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও কোন কাজ হয়নি। এখন আবার আমাদের সব শিল্পের উপর সার্ভিস চার্জ ৪ গুন বাড়ানো হয়েছে। অথচ সার্ভিসের কোনো বালাই এখানে নেই।
যশোর বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা মেহেদী হাসান এসব সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে আমরা গেল অর্থবছরে ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকার উন্নয়ন কাজ করা হয়েছে। এরমধ্যে রাস্তা ও ড্রেন রয়েছে।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, যশোর বিসিক একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চল। এখানে বিভিন্ন ধরণের শিল্প পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রকার আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছেনা। সহজ শর্তে আর্থিক সহযোগিতা পেলে বিসিকে আরও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠত। সেই সাথে পণ্য উৎপাদনও অনেক গুণ বেড়ে যেত।
এব্যাপারে যশোর বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক গোলাম হাফিজ জানান, করোনার মন্দাভাব কাটতে শুরু করেছে। গেল বছর এখানে ৬৫৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকার পন্য উৎপাদন হয়েছে। এর আগের তিন বছরে এই উৎপাদন নেমেছিল ৪শ কোটিতে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের সব ধরণের সুবিধা দিতে আমরা কাজ করছি। গেল বছর উন্নয়ন কাজ করা হয়েছে। চলতি বছরও বরাদ্দ পেলে করা হবে।