নিজস্ব প্রতিবেদক
না ফেরার দেশে চলে গেলেন যশোরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রিয় মুখ যশোর জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি পুনশ্চ যশোরের প্রতিষ্ঠাতা সুকুমার দাস। মাত্র ৬৬ বছর বয়সে বুধবার রাত ৯টা ১৫ মিনিটের দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
এদিন রাত নয়টার দিকে বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল তাকে হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালের আইসিইউতে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সুকুমার দাসকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে নেওয়া হবে যশোর টাউন হল ময়দানের রওশন আলী স্মৃতি মঞ্চে। এরপর ১১ টায় নীলগঞ্জ মহাশ্মশানে নেওয়া শেষকৃত্যের জন্য।
এরআগে গত ৫ এপ্রিল অসুস্থ হয়ে তিনি যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। এখানে চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন তার হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে। চিকিৎসকরা তাকে খুলনায় রেফার করেন। খুলনা সিটি হাসপাতালে তার হার্টে একটা রিং পরানো হয়।
৯ এপ্রিল যশোরে ফিরে আসেন তিনি।
যশোরে এসেই ওইদিনই তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে সন্ধ্যায় আবার যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপর সুস্থ হওয়ায় ১১ এপ্রিল দুপুরে তাকে বাড়িতে নেয়া হয়।

সুকুমার দাসের শ্যালক পুনশ্চ যশোরের সাধারণ সম্পাদক পান্না লাল দে জানান, চিকিৎসার পর দাদা ভালোই ছিলেন। কিন্তু রাত নয়টার দিকে তিনি খাটের উপর থেকে মেঝেতে পড়ে যান। দ্রুত তাকে হাসপাতালে আনার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে যশোরের অতিপরিচিত মুখ সুকুমার দাসের মৃত্যুর খবর শুনে সর্বস্তরের মানুষ হাসপাতালে ছুটে যান।
উল্লেখ্য, ১৯৫৭ সালের ২৭ শে নভেম্বর (১৩৬৪ সনের ১৩ অগ্রহায়ন) শ্রমিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা বিনয় কৃষ্ণ দাস এবং মা রেনু বালা দাস। সুকুমার দাস চুড়িপট্টি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন । ১৯৭৩ সালে সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৭৫ এ উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৭৯ তে সরকারি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স আর ১৯৮০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন।
১৯৭২ সালে ছাত্র রাজনীতিতে ( বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ) যুক্ত হন। আর ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি(সিপিবি) থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। ১৯৮৪ সালে তিনি বাঘারপাড়া ডিগ্রি কলেজে অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে যোগ দান করেন। ৭ সেপ্টম্বর ২০১৭ সালে ৩৩ বছরের চাকরি শেষে অবসর নেন তিনি। এর আগে তিনি দৈনিক স্ফুলিঙ্গে, ব্র্যাক, নিজেরা করি, ডিডিপিতেও কিছুৃদিন কাজ করেছেন। একমাত্র মেয়ে সিঁথি প্রষা দাস আর স্ত্রী শুক্লা দাসকে নিয়ে বর্তমানে তিনি বেজপাড়া টিবি ক্লিনিক রোডস্থ নিজ বাসভবনে বসবাস করছিলেন।
১৯৭৩ সালে যশোর উদীচীর সাথে যুক্ত হন এবং ২০১১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত একাধিকবার এ সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১১ সালের শেষ দিকে তিনি গড়ে তোলেন আরেক সাংস্কৃতিক সংগঠন পুনশ্চ। সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। যশোরে জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলনী পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, পদ্ধতিগত সঙ্গীত শিক্ষার বেসরকারি সঙ্গীত শিক্ষা বোর্ড ধ্রুব পরিষদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোরে দীর্ঘ ২৮ বছর তিনি মূল দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে কেন্দ্রীয় জোটের সদস্যসহ যশোরেরর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং জোটের খুলনা বিভাগের দায়িত্বরত ছিলেন। এছাড়া বর্তমানে টিআইবি যশোর সনাকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। একইসাথে যশোর শিল্পকলা একাডেমির সহসভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

তার সুরকরা গান ‘আয় আয় দিন বদলের প্রত্যয়’ গানটি যশোর জেলা প্রশাসনের ওয়েলকাম টিউন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তারই সুর করা আরেকটি গান ‘আরশীর সামনে একা একা দাঁড়িয়ে’ আজ উদীচীর সংগঠন সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তার সুর করা মাইকেল মধূসূদন দত্তের রচিত ব্রজাঙ্গনা কাব্য সনেট ও নাটকের অসংখ্য গান বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একাধিকবার পরিবেশিত হয়েছে । তিনি অসংখ্য দেশের গান, গণসঙ্গীত, ছড়া গান ও আধুনিক গানের সুর করেছেন। গণসঙ্গীতের প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি ঢাকা, খুলনা, রাজশাহীসহ সারাদেশে কাজ করেছেন।

তার নেতৃত্বে বাংলা ১৪০০ সনে যশোরে জাতীয় পর্যায়ে সপ্তাহব্যাপী লোকসঙ্গীত উৎসব, ১৯৯৯ সালে উদীচীর জাতীয় সম্মেলন, ২০১০ সালে জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলনী পরিষদের জাতীয় সম্মেলন, ১৯৯১ সালে ৮ দিনব্যাপী বিজয়ের বিশ বছর পালন হয়েছে। ১৯৮৮ সালে ৭ দিনব্যাপী পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, শান্তি নিকেতনসহ নানা অঞ্চলে গণসঙ্গীতের দল নিয়ে যান। যশোরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণের নানা উন্নয়নের সাথে তিনি সরাসরি সম্পৃক্ত।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুকুমার দাসের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন দৈনিক কল্যাণ পরিবার। পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক একরাম উদ দ্দৌলা, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এহসান উদ দৌলা ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এজাজ উদ্দিন টিপু শোক প্রকাশ করে বলেছেন, সুকুমার দাস ছিলেন যশোরের সাংস্কৃতিক জগতের প্রাণপুরুষ। তার অকাল প্রয়াণে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো।