“বিএনপি কিংবা অন্যরা যা-ই বলুক, বাস্তবতা এটাই যে, অনুসন্ধান বা সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত নাম থেকে রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। অনুসন্ধান কমিটি যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে কাদের নাম প্রস্তাব করবে তা আমরা জানি না। কিন্তু আমরা চাই তাদের নামই প্রস্তাব করা হোক, যারা অভিজ্ঞ, সৎ ও সুনামের কারণে অনেকের কাছে পরিচিত। তবে এটাও ঠিক এসব গুণ নিরূপণের তেমন সর্বজনমান্য কোনো মাপকাঠি নেই। অনেকটা ধারণার ওপর ভিত্তি করেই এটা করতে হবে। তবে বিতর্ক যতটা এড়ানো যায়, সেদিকে নজর থাকলে ভালো হবে”
বিভুরঞ্জন সরকার: স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন আইনের দাবি ছিল এতদিন। এবার অনেকটা আকস্মিকভাবেই সে আইন হয়েছে। গত ২৭ জানুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২ জাতীয় সংসদে পাস হয়। পরে রাষ্ট্রপতি বিলে স্বাক্ষর দেওয়ার মাধ্যমে এটা আইনে পরিণত হয়েছে। নতুন আইনের বিধান অনুযায়ী যোগ্য ব্যক্তি বাছাইয়ের জন্য ৫ ফেব্রুয়ারি ৬ সদস্যের সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে প্রধান করে গঠিত ওই কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন হাইকোর্টের বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। আইন অনুযায়ী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের প্রতিটি পদের জন্য ২ জন করে ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করবে অনুসন্ধান কমিটি। ওই ১০ জনের মধ্য থেকে সিইসিসহ মোট ৫ জনকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। ইতিমধ্যেই যোগ্য ব্যক্তিদের অনুসন্ধান শুরু করেছে কমিটি।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তাদের পছন্দের নাম চাওয়া হয়েছে। আগামী শনি ও রোববার ৬০ জন বিশিষ্ট নাগরিক ও পেশাজীবীর সঙ্গে বৈঠক করে তাদের পরামর্শ নেবে কমিটি। এর বাইরে ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে নাম প্রস্তাব করছেন। যাচাই-বাছাই করে কমিটি যে ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করবে, তার থেকে ৫ জনকে নিয়ে যে কমিশন গঠিত হবে, তা কি বিতর্কমুক্ত হবে? দেশের অন্যতম একটি রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয় না যে, নতুন প্রক্রিয়ায় গঠিত নির্বাচন কমিশন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিতর্ক সম্ভবত কমিশন ঘোষণার পরও অব্যাহত থাকবে। কারণ এ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্যের সুযোগ নেই। বিএনপি দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। কিন্তু সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির কোনো ইস্যুতেই সমঝোতা বা একমত হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এই দুই বড় রাজনৈতিক দলের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে দেশের রাজনীতির সিংহভাগ সংকট তৈরি হয়েছে। এদের একে অপরের ভালো কিছু দেখে না। ছিদ্র অন্বেষণের অক্লান্ত প্রয়াস তারা বছরের পর বছর চালিয়ে যাচ্ছে। এর থেকে বেরিয়ে আসার সহজ কোনো পথ আছে বলে কেউ মনে করেন না।
সংবিধানে নির্বাচন কমিশন আইনের কথা থাকলেও এতদিন কোনো সরকারই ওই আইন প্রণয়নের গরজ বোধ করেনি। নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি সামনে এলে এই দাবি জোরালো হয়। তারপর আবার ভুলে যাওয়া। এবার শুরুতে সরকার আপত্তি জানালেও অনেকটা আকস্মিকভাবেই সরকারের মত পরিবর্তন হয়। সরকার আইন করার উদ্যোগ নিলে বিরোধীরা যথারীতি তার প্রতিবাদ করে বলতে থাকে, তাড়াহুড়ো করে আইন করলে সে আইন প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে আইনের একটি খসড়া জাতির সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। সেটা করা হলে সরকারের প্রণীত আইনের ফাঁকফোকর বোঝা সহজ হতো।
বলা হচ্ছে, সরকার তার ইচ্ছা পূরণের বা ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার জন্যই এই আইন করেছে। এসব কথা যে কোনো অর্থ বহন করে না, সেটা বলা নিষ্প্রয়োজন। সরকার নিশ্চয়ই তার নিজস্ব ভাবনা থেকেই কাজ করবে। বিরোধী দলের বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে বিএনপির সুবিধা হয়, তেমন কিছু নিশ্চয়ই করবে না। বিএনপি আইনে কি চায়, তার রূপরেখা কি কখনো প্রকাশ করেছে?
নতুন আইনের বিধান অনুযায়ী সার্চ কমিটি গঠন করার পর বলা হচ্ছে, সরকারের পছন্দের লোক দিয়ে এই কমিটি করেছে। কমিটির ৬ সদস্যের ৪ জনই বিভিন্ন সাংবিধানিক পদের অধিকারী। তাদের নিয়ে এখন নতুন করে বিতর্ক তোলা কিংবা তাদের সরকার অনুগত বলে প্রচার করাটা দুরভিসন্ধিমূলক। এটা পানি ঘোলা করার অসৎ উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। বিএনপি এবং সরকারবিরোধীরা এখন সমবেত চিৎকারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে কতটা সুবিধা অর্জন করতে পারবে তা বলা কঠিন।
বিএনপি কিংবা অন্যরা যা-ই বলুক, বাস্তবতা এটাই যে, অনুসন্ধান বা সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত নাম থেকে রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। অনুসন্ধান কমিটি যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে কাদের নাম প্রস্তাব করবে তা আমরা জানি না। কিন্তু আমরা চাই তাদের নামই প্রস্তাব করা হোক, যারা অভিজ্ঞ, সৎ ও সুনামের কারণে অনেকের কাছে পরিচিত। তবে এটাও ঠিক এসব গুণ নিরূপণের তেমন সর্বজনমান্য কোনো মাপকাঠি নেই। অনেকটা ধারণার ওপর ভিত্তি করেই এটা করতে হবে। তবে বিতর্ক যতটা এড়ানো যায়, সেদিকে নজর থাকলে ভালো হবে।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সাধারণত সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদেরই বেছে নেওয়া হয়। এবার সমাজের অন্য শ্রেণি-পেশার দক্ষ, অভিজ্ঞ ও সৎ হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিদের দিকে অনুসন্ধান কমিটি নজর দিলে খারাপ হবে না। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ, তিনি শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক বা অন্য যে পেশারই হন না কেন, তিনি দায়িত্ব পালনে সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেন।
আমাদের সমাজ যেহেতু রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত সেহেতু কোনো ইস্যুতে একমত হওয়ার সুযোগ কম। তাছাড়া যেকোনো মানুষকে বিতর্কিত করা, বা দোষ খুঁজে বের করাও আমাদের একটি বদঅভ্যেসে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের সদস্য হিসেবে যার নামই প্রস্তাব করা হবে, তারই কোনো না কোনো কানেকশন খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না। দেশটা আমাদের ছোট, কিন্তু মানুষ অনেক। আবার মানুষে মানুষে যোগাযোগ বা আত্মীয়তা খুঁজে বের করাও সহজ। আমাদের উচ্চশিক্ষা পাওয়া মেধাবী মানুষেরা ছাত্র জীবনে কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তা নয়। আবার অনেকের আত্মীয়স্বজন হয়তো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সেজন্য কোনো প্রস্তাবিত নামের ঠিকুজি না ঘটে দেখা উচিত, তিনি দক্ষ ও বিষয় অভিজ্ঞ কি না। তিনি অন্যায় ও অনিয়ম করেছেন কি না। তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কি না।
আমাদের অনেকেই দেশে একটি ভালো বা বিতর্কমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের ওপর অহেতুক অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে পুরো ব্যবস্থাপনা বা সিস্টেম সহায়ক না হলে শুধু পাঁচজনের একটি নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল ও প্রার্থীদের আচরণ এবং মাঠ প্রশাসনের ভূমিকা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশনের সদস্য যারা হবেন, তাদের মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণত যেসব প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়, সেগুলো দূর করার হিম্মত থাকতে হবে। অন্যায় আবদারের কাছে নত না হওয়ার বুকের পাটা সবার থাকে না। নতুন কমিশন সদস্য হিসেবে অন্তত এমন ব্যক্তিদের বেছে নেওয়া হোক যারা সত্য কথা বলতে ভয় পাবেন না। পদের মোহ ত্যাগ করতেও যারা হবেন দ্বিধাহীন।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক