জাহিদ হাসান
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ৫-৬ মাস বাকি। দলের টিকিট পেতে সম্ভাব্য প্রার্থীরা বসে নেই। কেন্দ্রে করছেন তদ্বির। জনগণের সাথে বাড়িয়েছেন যোগাযোগ। সারা দেশের মতো এ চিত্র যশোর-৪ (অভয়নগর-বাঘারপাড়া ও বসুন্দিয়া ইউনিয়ন) আসনেও। এই আসনে নৌকার মনোনয়নের জন্য মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগের এক ঝাঁক নেতা। ব্যানার ফেস্টুন টাঙিয়ে, সভা-সমাবেশ, মতবিনিময়ে ব্যস্ত রয়েছেন তারা। মেডিকেল ক্যাম্প, বস্ত্র বিতরণের মতো কর্মসূচিতেও মাঠ সরগরম করে তুলেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। বসে নেই বিএনপি-জাতীয় পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশীরাও। এখানে আওয়ামী লীগ চায় তাদের ঘাঁটি ধরে রাখতে। আর বিএনপি চায় এই ঘাঁটি দখল করতে।
অভয়নগর ও বাঘারপাড়া উপজেলা এবং সদরের বসুন্দিয়া ইউনিয়ন নিয়ে যশোর-৪ আসন গঠিত। দুটি উপজেলা, দুটি পৌরসভা এবং ১৮ ইউনিয়নের এ আসনটিতে মোট ভোটার ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৮৫৪ জন। বিগত এগারটি নির্বাচনে সাতবার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী দু’বার করে বিজয়ী হয়েছেন। এই আসনে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শাহ হাদিউজ্জামান, ১৯৭৯ সালে বিএনপির নাজিম উদ্দিন আল আজাদ, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শাহ হাদিউজ্জামান, ১৯৮৮ জাতীয় পার্টির হয়ে নাজিম উদ্দিন আল আজাদ, ১৯৯১ সালে শাহ হাদিউজ্জামান, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির নজরুল ইসলাম, ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনের আওয়ামী লীগের শাহ হাদিউজ্জামান, ২০০১ সালে চারদলীয় জোট থেকে জাপা’র (নাফি) এমএম আমিন উদ্দিন বিজয়ী হন। এরপর ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে টানা তিনবার এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের রণজিত কুমার রায়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় অন্তত ১০ জনের নাম রয়েছে। তারা হলেন বর্তমান সংসদ সদস্য রণজিত কুমার রায়, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন, যশোর মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. নিকুঞ্জ বিহারী গোলদার, সাবেক অতিরিক্ত সচিব (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়) সন্তোষ অধিকারী, সাবেক হুইপ শেখ আবদুল ওহাব, অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র এনামুল হক বাবুল, সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর চেয়ারম্যান সরদার অলিয়ার রহমান, যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ, অভয়নগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহ্ ফরিদ জাহাঙ্গীর, জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আশরাফুল কবির বিপুল ফারাজী ও আওয়ামী লীগ নেতা আরশাদ পারভেজ। অপরদিকে, বিএনপির প্রার্থী তালিকায় নাম রয়েছেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার টিএস আইয়ূব ও ফারাজী মতিয়ার রহমান এবং বাঘাপাড়া পৌর বিএনপির সভাপতি আব্দুল হাই মনা। এছাড়া জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অ্যাডভোকেট জহুরুল হক জহিরও মাঠে রয়েছেন।
মনোনয়নপ্রত্যাশীরা জনসমর্থন আদায়ে মাঠ পর্যায়ে মতবিনিময়, গণসংযোগ সভা-সমাবেশ করে চলেছেন। পাশাপাশি সামাজিক, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সহায়তার মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন। ফেসবুকেও সরব রয়েছেন তাদের সমর্থকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানে আওয়ামী লীগের রণজিৎ কুমার রায় তিনবারের এমপি হলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের সিংহভাগ নেতাকর্মীর সাথে তার অনেক আগে থেকেই দূরত্ব রয়েছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনতে ঘিরে সেই দূরত্বের মাত্রা আরো বেড়েছে। অনেকের সাথে তার মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত নেই। নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করা, চিহ্নিত রাজাকার আমজাদ মোল্যার (যুদ্ধাপরাধ মামলায় সম্প্রতি তারসহ চারজনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে) পক্ষে অবস্থান নেয়ায় আওয়ামী লীগ নেতারা তার উপর ক্ষুব্ধ। খোদ বাঘারপাড়া উপজেলা সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা হাসান আলী সভাপতি রণজিৎ রায়ের সাথে একমঞ্চে যান না। অন্য নেতারাও নিজস্ব বলয় নিয়ে পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করেন। এমপি রণজিত কুমার রায়ের বিরুদ্ধে বাঘারপাড়ার আওয়ামী লীগের নেতারা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন। সেখানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অর্থের বিনিময়ে জামায়াত-বিএনপির নেতাদের চাকরি দেয়ার নানা অভিযোগ করেন তারা।
এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশায় বিগত কয়েকবছর ধরে মাঠে রয়েছেন যশোর মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. নিকুঞ্জ বিহারী গোলদার। ২০১৬ সালে অবসরে যাওয়ার পর থেকে তিনি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্মরণে বাঘারপাড়া, অভয়নগর ও বসুন্দিয়ায় এলাকার অসহায় ও দরিদ্র নারী ও প্রসূতিদের ফ্রি চিকিৎসা দিচ্ছেন। ডা. নিকুঞ্জ বলেন, গ্রামের স্বল্প আয়ের পরিবারের নারী ও প্রসূতি মায়েরা গাইনি বিষয়ক নানা জটিল ও কঠিন রোগে ভুগলেও অর্থের অভাবে শহরে গিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা নিতে পারেন না। তাদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্মরণে প্রতি সপ্তাহে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজনের মাধ্যমে সুচিকিৎসা প্রদান করছি। দরিদ্র অনেক নারীর সিজারিয়ান অপারেশনও বিনামূল্যে করে দিয়েছি। এলাকার মানুষকে ফ্রি চিকিৎসা সেবা দিয়ে আমি সাড়া ফেলেছি, জনগণ আমাকে সংসদ সদস্য হিসাবে দেখাতে চায়।
যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ বলেন, আমি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সদরে সংগঠনের নেতৃত্ব দিলেও যশোর-৪ আসনের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। সেখানকার নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। সেখানে প্রার্থী হওয়ার জন্য তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি নেত্রী আমাকে মূল্যায়ন করবেন।
এই আসনের আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এনামুল হক বাবুল। নওয়াপাড়ার পৌরসভার মেয়র হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ২০০৩ সাল থেকে পর পর দুই বার অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি বলেন, ‘সবকিছু উজাড় করেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে রয়েছি। ইতোপূর্বে পৌরসভার মেয়র হিসেবে মানুষের সেবা করেছি। দলের কাছে মনোনয়ন চাইবো। দল চাইলে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবো। তবে দল যাকেই নৌকা দেবে; তাকে নিয়েই ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী মাঠে থাকবো।
মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক পৌর চেয়ারম্যান সরদার অলিয়ার রহমানও। তিনি বলেন, বর্তমানে এই আসনে যিনি এমপি আছেন; মনোনয়ন পাওয়ার পর আমরাই ঐক্যবদ্ধ থেকে তাকে নির্বাচিত করেছি। কিন্তু বিজয়ের পর তিনি আর দলের খোঁজ-খবর রাখেননি। তাই আমরা নতুন প্রার্থী চাই। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার সাথেই থাকবো।’
সাবেক অতিরিক্ত সচিব (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রাণালয়) সন্তোষ অধিকারীর বাড়ি বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাকোলা গ্রামে। অবসরে যাওয়ার পর তিনিও এলাকায় গণসংযোগ করছেন। এছাড়াও এই আসনে মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে শামিল রয়েছেন সাবেক হুইপ শেখ আবদুল ওহাব, অভয়নগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহ্ ফরিদ জাহাঙ্গীর, জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আশরাফুল কবির বিপুল ফারাজী ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আরশাদ পারভেজ।
জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আশরাফুল কবির বিপুল ফারাজী বলেন, অনেক আগে থেকে জনগণের সাথে আছি। সরকারের উন্নয়ন প্রচার করছি। নৌকার মনোনয়ন পেলে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে প্রধানমন্ত্রীকে বিজয় উপহার দেব।
আরশাদ পারভেজ বলেন, আওয়ামী লীগ গণমুখী ও সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক দল। তাই দলের নেতাকর্মীদের সাথে থেকে তৃণমূলে সক্রিয় রয়েছি। নির্বাচনে নৌকাকে বিজয়ী করতে কাজ করে যাচ্ছি।
আওয়ামী লীগের বিপরীতে এই আসনে বিএনপির অন্যতম প্রার্থী কেন্দ্রীয় নেতা প্রকৌশলী টিএস আইয়ুব। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি অল্প ভোটের ব্যবধানে নৌকার কাছে হেরে যান। গত নির্বাচনেও তিনি মনোনয়ন পেয়েছিলেন। নির্বাচনী এলাকায় বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী তার সাথে রয়েছে। ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তার প্রমাণ দিয়েছেন নেতাকর্মীরা। তবে বিদেশে অর্থ পাচার মামলায় প্রায় ১১ মাস কারাবরণ করে সম্প্রতি তিনি মুক্তি পেয়েছেন। যদিও দলের মনোনয়নের ক্ষেত্রে টিএস আইয়ুবই এগিয়ে থাকবেন বলে জানান বাঘারপাড়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শামসুর রহমান।
শামসুর রহমান বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে টিএস আইয়ুবের জনপ্রিয়তা অনেক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই আসনের বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরে রেখেছেন। মামলা, হামলা, অত্যাচার নির্যাতনে নেতাকর্মীদের পাশে থেকেছেন। তিনি নিজেও বহুবার কারাগারে গেছেন। ফলে দল নির্বাচনে গেলে তিনিই অন্যতম মনোনয়নপ্রত্যাশী। দল যাকে মনোনয়ন দেবে তাকে নিয়েই ধানের শীষের পক্ষে তারা মাঠে থাকবেন।
এই আসনে বিএনপির আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী বাঘারপাড়ার পৌর বিএনপি’র সভাপতি আব্দুল হাই মনা। তার পিতা আব্দুল খালেক ছিলেন বাঘারপাড়া বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সেই সূত্রে তিনি রাজনীতিতে আসেন। স্থানীয় রাজনীতিতে আব্দুল হাই মনার সাথে বিরোধ আছে টিএস আইয়ুবের। আব্দুল হাই মনা বলেন, দল নির্বাচনে গেলে মনোনয়ন চাইবো। তবে মামলা, হামলা, নির্যাতনে আমাদের নেতাকর্মীরা জর্জরিত। তাদেরকে সাথে নিয়ে নির্বাচনী মাঠে থাকতে হবে। দল যাকে প্রতীক দেবে তার সাথে থেকেই নির্বাচন করবো।
অভয়নগর বিএনপির আহ্বায়ক ফারাজী মতিয়ার রহমানও অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গণসংযোগ করছেন নির্বাচনী এলাকায়। ফারাজী মতিয়ার রহমান বলেন, মনোনয়ন চাইবো। দল আমার অবস্থান বিবেচনা করে মনোনয়ন দিলে অভয়নগরবাসী খুশি হবেন। কারণ এই আসনের ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু নওয়াপাড়াভিত্তিক। আওয়ামী লীগ, বিএনপির বাইরে এই এলাকায় সরব রয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক নেতা অ্যাডভোকেট জহুরুল হক জহির। বিগত নির্বাচনেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। অ্যাড. জহুরুল হক জহির বলেন, ‘মাঠের কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে। সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছি। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড, সভা, সমাবেশ ও গণসংযোগ করে তৃণমূলে সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। দলের চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দও এ বিষয়ে অবহিত। তাই দলীয় মনোনয়ন নিয়েই নির্বাচনী লড়াইয়ে থাকতে চায়। তবে দল পৃথক বা জোটবদ্ধ যেভাবেই নির্বাচনী ময়দানে থাকবে; সেভাবেই দলের সিদ্ধান্ত মেনে মাঠে থাকবো।’