# কাঁচা মরিচ কেজি ২০০ টাকা, বেগুন ১২০ টাকা, টমেটো ১২০ টাকা, শিম বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা
# ব্রয়লার মুরগি কেজি ১৮০ টাকা ও সোনালি মুরগি ২৮০-৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে
# এক ডজন ডিমের দাম ১৩৫-১৪০ টাকা
নিজস্ব প্রতিবেদক
হঠাৎ করেই নিত্যপণ্যের বাজার আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও বাজারে পণ্যের দামে লাগা আগুন এখন নিত্য-নৈমিত্তিক।
এতে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। খেটে খাওয়া মানুষদের ইচ্ছে থাকলেও উচ্চমূল্যের কারণে তারা সাধ্যের মধ্যে মাছ-মাংস কিনতে পারছেন না। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ডাল, ভাত আর সবজি জোগাড় করাই এখন স্বপ্নের মতো। পুষ্টির চাহিদা মেটাতে একমাত্র ভরসা হয়ে উঠেছে ডিম; কিন্তু সেটিও এখন অনেকের নাগালের বাইরে। ক্রমবর্ধমান দামের চাপে নিম্নবিত্তের মতো মধ্যবিত্তরাও পড়েছেন বেকায়দায়।
নিত্যপণ্যের দাম সামলাতে গিয়ে সাধারণ মানুষ এখন তাদের খাদ্যতালিকা ছোট করে ফেলছে। প্রয়োজনের তুলনায় কম কিনে কোনোভাবে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু বাজার খরচই নয়, নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে চিকিৎসা, শিক্ষা ও যাতায়াতসহ প্রায় সব খাতে। সব মিলিয়ে পণ্যের দাম মেটাতে গিয়ে অনেক প্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন মধ্যবিত্তরা। আর সাধারণ ও নিম্নবিত্ত মানুষ চুলায় হাঁড়ি তুলতেই হিমশিম খাচ্ছে।
প্রায় প্রতিদিন আমরা অভিযান চালায়। অসাধু পন্থায় দাম বাড়ালে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়। ভোক্তার স্বার্থে কার্যক্রম চলমান থাকবে।
– মো. সেলিমুজ্জামান, সহকারী পরিচালক, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, যশোর
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশে কৃষিপণ্য এখনো পুরোপুরি সংরক্ষণনির্ভর নয়। তাই কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মৌসুমি ঘাটতি বা পরিবহন সংকট দেখা দিলেই সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। এই অস্থিরতার বড় কারণ হলো মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে পণ্য কিনে শহরের বাজারে অনেক বেশি দামে বিক্রি করেন। এ ছাড়া ডলারের উচ্চ বিনিময় হারও দামের ওপর বড় প্রভাব ফেলে। কারণ ডাল, ভোজ্যতেল, মসলা ও কিছু ফল আমদানি নির্ভর পণ্য। ডলারের দাম বাড়লে এসব পণ্যের দামও বেড়ে যায়।
তারা আরও জানান, ব্যবসায়ীদের গোপন সমন্বয় বা অঘোষিত চুক্তির মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে পণ্যের ঘাটতি তৈরি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে, এমন অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা খুবই সীমিত। এমনকি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানও অনেক সময় স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারছে না।
এদিকে সরকারি পর্যায়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন টিম কাজ করছে এবং যেখানে সমস্যা ধরা পড়ছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে বাস্তবে ভোক্তারা এর তেমন সুফল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। দাম ওঠানামার কারণ হিসেবে ভোক্তা, ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা উল্লেখ করছেন— দুর্বল মনিটরিং, সরবরাহ চেইনের সমস্যা, পরিবহন সংকট, জ্বালানি তেলের বাড়তি খরচ, বাজার সিন্ডিকেট এবং কারসাজিকে।
যশোর শহরের বড়বাজার, রেলস্টেশন বাজার, সাবেক চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে সংশ্লিষ্ট ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তিনি সরেজমিনে দেখেছেন, প্রতিদিনই শাক-সবজি, চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, মসলা, সবজি, ডিম, মুরগি ও মাছের দাম পরিবর্তন হচ্ছে। বাজারে কোনো নির্দিষ্ট দামের নিশ্চয়তা নেই। একেক দিন একেক দোকানে ভিন্ন ভিন্ন দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। কোনো দোকানে হয়ত কিছু কমে, আবার কোনো দোকানে বাড়তি দামে নিত্যদিনের জিনিস বিক্রি হচ্ছে।
এতে গত সপ্তাহে প্রায় সব ধরনের সবজির দাম কেজিতে ২০-৩০ টাকা বেড়ে যায়। সপ্তাহ শেষে সেই দাম কিছুটা কমেছে। তবে সার্বিকভাবে সবজির বাজার চড়া। বেশি দামে সবজি কিনতে গিয়ে অস্বস্তির কথা জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ।
এ ছাড়া এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে কিছুটা বেড়েছে খোলা সয়াবিন তেল ও পেঁয়াজের দাম। অন্যান্য পণ্য আগের দামেই অপরিবর্তিত রয়েছে। গতকাল যশোর শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড, বড় বাজার, রেল বাজার ঘুরে এবং বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিক্রেতারা জানিয়েছেন, গত দুই সপ্তাহে সরবরাহ এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই কমবেশি বৃষ্টি হয়েছে। এতে বাজারে সবজির সরবরাহ কমে যায়; বাড়ে দাম। এ ছাড়া দুর্গাপূজা উপলক্ষে তিন-চার দিন ছুটি ছিল। এ সময় ভারত থেকে কাঁচা মরিচ ও টমেটো আমদানি কমায় পণ্য দুটির দামও বেড়ে যায়। অবশ্য সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়ে সরবরাহ বাড়লে মরিচ ও টমেটোর দাম কমে আসে।
দুই সপ্তাহ আগে বাজারে এক কেজি কাঁচা মরিচের দাম ছিল ১৮০-২০০ টাকা। গত সপ্তাহে মরিচের দাম কেজিতে প্রায় ২০০ টাকা বেড়ে যায়। তাতে এক কেজি মরিচের দাম ৪০০ টাকায় উঠেছিল। এরপর সরবরাহ বাড়লে দাম আবার কমে আসে। গতকাল খুচরা বাজারে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ২০০ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
অন্যান্য সবজির দামও বেশ চড়া। বেগুনের কথা ধরা যাক। বাজারে ১২০ টাকার নিচে কোনো ধরনের বেগুন কেনা যায় না। টমেটোর দামও প্রায় কাছাকাছি; কেজি ১২০ টাকা। অবশ্য টমেটো এই মৌসুমের সবজি নয়; এটি ভারত থেকে আমদানি হয়। দুই সপ্তাহ আগে মানভেদে এক কেজি বেগুন ৮০-১৫০ টাকা ও টমেটো ১০০ টাকায় কেনা যেত। বাজারে উঠেছে নতুন শিম। বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা।
মোটামুটি ৪০ টাকা কেজির নিচে তেমন কোনো সবজি কেনা যায় না। বেশ কিছু সবজির কেজি ৬০ টাকার ওপরে। যেমন কাঁকরোল, করলা, ঢ্যাঁড়স, বরবটি, লতির মতো সবজি ৮০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। আর ঝিঙে, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, পটোল, মুলা প্রভৃতি ৫০-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। একটি লাউয়ের দামও ৬০ টাকার ওপরে। সবজির মধ্যে কম দাম পেঁপে ও আলুর। প্রতি কেজি পেঁপে ২০-৩০ টাকা ও আলুর দাম ২০-২৫ টাকা।
বিক্রেতারা জানিয়েছেন, গ্রীষ্ম মৌসুমের এই সময়ে চাহিদার তুলনায় সবজির সরবরাহ কিছুটা কম থাকে। তবে এক-দেড় মাসের মধ্যে শীতের সবজি বাজারে আসতে শুরু করবে। তখন দাম কমে আসবে।
গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে খোলা সয়াবিন তেল ও দেশি পেঁয়াজের দাম কিছুটা বেড়েছে। আর সাধারণ মানের সরু চালের দাম সামান্য কমেছে। খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ২ টাকা বেড়ে ১৭২-১৮০ টাকা হয়েছে। আর পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৭০-৭৫ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া রসুন ও আদার দাম স্থিতিশীল রয়েছে।
এদিকে বাজারে দু-তিন মাস ধরেই মাছ, মুরগি ও চালের দাম চড়া। মাসখানেক আগে এর বাইরে গত এক মাসের মধ্যে আটা, মসুর ও মুগ ডালের দামও বেড়েছিল। বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৮০ টাকা ও সোনালি মুরগি ২৮০-৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর এক ডজন ডিম বিক্রি হয়েছে ১৩৫-১৪০ টাকায়। বিভিন্ন ধরনের মাছের মধ্যে প্রতি কেজি তেলাপিয়া ২২০ থেকে ৩০০ টাকা, পাঙাশ ১৮০-২৫০ টাকা, কই ২৪০-২৮০ টাকা এবং রুই ৩৫০-৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
যশোর শহরের মিশনপাড়া এলাকার গৃহবধূ শাহিনা আক্তার বড় বাজার থেকে এক কেজি বেগুন, ৫০০ গ্রাম কাঁচা মরিচ, এক কেজি কলা ও ৫০০ গ্রাম নতুন শীতকালীন সবজি হিসেবে শিম কেনেন। এই চার পদের সবজি কিনতে তাঁর মোট খরচ হয় ৩২০ টাকা।
শাহিনা আক্তার বলেন, ‘বাজারে মোটামুটি সব জিনিসের দামই বেশি। বিশেষ করে সবজির দাম। আগে এক হাজার টাকার বাজার করলে এক সপ্তাহ চলে যেত। এখন দেড় হাজার টাকায়ও সপ্তাহ পার হতে চায় না। চার পদের সবজি কিনতেই ৩০০ টাকা শেষ হয়ে গেল।’
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের যশোরের সহকারী পরিচালক মো. সেলিমুজ্জামান বলেন, আমাদের অভিযান থেমে নেই। তিনি বলেন, প্রায় প্রতিদিন আমরা অভিযান চালায়। অসাধু পন্থায় দাম বাড়ালে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়। ভোক্তার স্বার্থে কার্যক্রম চলমান থাকবে।
