মো. মোফাজ্জেল হোসেন: হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের মাথা উঁচু করে চলতে শিখিয়েছেন। আর তাই শত বাঁধা-বিপত্তি, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিয়েছেন। পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার স্বপ্নের একটি প্রকল্প। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন আজ বাস্তবায়ন করা হলো। পদ্মা সেতু দেশের দীর্ঘতম সেতু। পানি প্রবাহের দিক দিয়ে দীর্ঘতম নদী অ্যামাজানের পর পদ্মা নদীই বিশ্বে বৃহত্তম। কারিগরি ও প্রযুক্তির বাঁধা জয় করে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু শুধু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রতীক নয়, সেতুটি অভূতপূর্ব। পদ্মা সেতু বাঙালির গর্বের প্রতীক, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রতীক। এই প্রতীক যুগ যুগ ধরে বাঙালিকে সামনের দিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
২৫ জুন ২০২২ নতুন সম্ভাবনা, নতুন দিগন্ত নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে এই সেতু। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো বিশে^র জন্যেই এ এক পরম বিস্ময়। বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা তাঁর পিতার মতো সততা, আত্মবিশ্বাস ও বলিষ্টতার মাধ্যমে এই সেতু বাস্তবায়ন করেছেন। প্রবল ¯্রােতের এই পদ্মায় সেতুটি তৈরি করতে আধুনিক মানের সব উপকরন ব্যবহার করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন ‘সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না।..তাদের কেউ দাবাতে পারবে না’। এই উক্তি পরাধীন জাতির জন্য স্বাধীনতার দৃপ্ত শপথে উজ্জীবিত হওয়ার বীজমন্ত্র। ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম এক বাংলাদেশ হিসেবে বিশ^ মানচিত্রে আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে তা সত্যে পরিণত হয়েছে। অর্ধশত বছর পর ২০২২ সালে এসেও সেই সত্য প্রতিভাত হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। পদ্মা সেতু হচ্ছে বাঙালিদের দাবিয়ে না রাখতে পারার প্রতীক। বাঙালি জাতি কারও কাছে মাথা নত করেনি, কোনোদিন করবেও না। পদ্মা সেতু আমাদের স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন এখন বাস্তব। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। এটা দেশের মানুষের জন্য গর্ব করার মতো বিষয়।
২ জুন ২০২২ খ্রি. তারিখে দ্যা ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দেশের জনগণ পাশে থাকায় পদ্মা সেতুর কাজ সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে’। ত্রিশ হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত এই সড়ক ও রেলসেতু কেবল একটি মেগা প্রকল্প নয়,পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীকে। পদ্মা সেতু আমাদের স্বনির্ভরতার চ্যালেঞ্জ। এর উপর বাংলাদেশের ভবিষ্যত অনেকটাই নির্ভর করছে। এই সেতু শুধু একটি স্থাপনা নয়, আত্মমর্যাদা ও অহংকারের প্রতীক। এই সেতু নির্মানের সময় অনেক জল্পনা কল্পনা ও গুজব ছিল। সেতুটি ঘিরে বিশ্ব ব্যাংকসহ দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র হয়েছিল। ২০১২ সালে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ^ব্যাংক যখন পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণচুক্তি বাতিল করে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও জটিল রকমের প্রাকৃতিক প্রতিকুলতা মোকাবেলা করে ২০১৩ সালের মে মাসে আপনার, আমাদের নিজেদের অর্থেই সেতু নির্মাণের সংকল্প ব্যক্ত করেন। দেশবাসীও তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সামর্থ অনুযায়ী এগিয়ে এসেছে। এখন বাংলাদেশকে স্যালুট দিচ্ছে সবাই। সকল ষড়যন্ত্রকারীদের মুখে ছাই দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বেই অবশেষে পদ্মার বুকে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হয়েছে। আজ এই সেতু দাঁড়িয়ে জানান দিচ্ছে, বাঙালি বীরের জাতি।
বিশালত্বের দিক থেকে অর্থায়ন ও কর্মসম্পাদন যে একক ভাবে সম্পন্ন করা যায় তা আজ বাস্তবিক। এ সেতু আমাদের সেতু, আমাদের গর্ব, আত্মমর্যাদা ও অহংকারের বিষয়। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এই সেতুর মালিক। কারণ এর অর্থায়ন করেছে এ দেশেরর সর্বস্তরের জনগণ। সুতরাং এই সেতু বাস্তবায়নে সক্ষমতা, স্বপ্ন ও চ্যালেঞ্জের মধ্যকার যে মজবুত সেতু বন্ধন রচিত হয়েছে তার গৌরব ও মালিকনা নিতান্তই এদেশের মানুষের। দেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী পদ্মার উপর নির্মিত ৬.১৫ কি. মি. সড়ক ও রেলসেতুর উপর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার যানবাহন চলাচল করবে অর্থাৎ দক্ষিণ, পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের সোনালি ভবিষ্যতকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করে সার্বিক উন্নয়নে প্রভৃত ভূমিকা রাখবে। এ প্রসঙ্গে ১৫ জুন ২০২২ খ্রি. দৈনিক খোলা কাগজে প্রকাশিত সংবাদে সজিব ওয়াজেদ জয়ের অনুভূতি প্রকাশ , ‘এই সেতু নির্মানের ফলে দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নদী বেষ্টিত ভূ-খন্ড সরাসরি রাজধানীর সঙ্গে সংযুক্ত হবে। পদ্মা সেতু যেমন দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৫ কোটি মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক সুবাতাস বয়ে আনবে, তেমনি কমপক্ষে এক দশমিক পাঁচ শতাংশ জাতীয় আয় বৃদ্ধিও নিশ্চিত করবে। ফলে লাভবান হবে পুরো দেশের মানুষ। প্রসার হবে ব্যবসা বাণিজ্য ও পর্যটনের। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নির্মাণে এই সেতুর প্রভাব হবে অনেক।’
সেতুটি নির্মিত হওয়ার ফলে দেশের সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবহার উন্নতি হবে। ঢাকা থেকে মাওয়া-ভাঙ্গা-যশোর-খুলনা রেল সংযোগ স্থাপন করা হচ্ছে। খুলনা, মংলা, বরিশাল, কুয়াকাটায় অর্থনৈতিক করিডোর খুলে যাচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সংগে যুক্ত হচ্ছে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা হচ্ছে। এতে করে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সুবিধা হবে। আশা করা যাচ্ছে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক স্থাপনের ফলে দেশি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। দেশের শিল্পায়ণ তরান্বিত হবে। পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হবে এবং মাওয়া ও জাজিরায় গড়ে উঠবে নতুন রিসোর্ট, হোটেল, শপিংমল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। মংলা ও পায়রা বান্দর চালু থাকবে যা ব্যবহার করতে পারবে প্রতিবেশী দেশগুলো।
একটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়নে পূর্বশর্ত হলো সেই অঞ্চলগুলোর জন্য একটি উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সেই ব্যবস্থাকে গতিশীল করতেই এই সেতু। আমাদের গর্বের সেতু দাড়িয়ে আছে যা দেখে উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিতেও ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বিশ^ব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীরা অনুধাবন করতে পেরেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে এসে তারা ভুল করেছে। এখন উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে যেমন মেট্রোরেল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রভৃতিতে ঋণ দিচ্ছে। পদ¥া সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে আত্মবিশ^াসী করে তুলেছে। বর্তমানে দেশে ১০-১২টি মেগাপ্রকল্প চলছে যার পথিকৃৎ পদ্মাসেতু। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবশেষে বলতে চাই পদ্মা সেতু হচ্ছে আমাদের জাতিসত্তার বিজয়, মর্যাদা-অহংকারের নাম।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, যশোর সরকারি মহিলা কলেজ, যশোর।