জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: গান, নৃত্যানুষ্ঠান, আলোচনা সভা ও পুরস্কার গ্রহণের মধ্যদিয়ে অন্যরকম একটি দিন পার করলেন পাঁচ শতাধিক ষাটোর্ধ্ব নারী। বয়োবৃদ্ধ এসব চলচ্ছক্তিহীন মায়েরা বুধবার পার করেছেন হাসি-আনন্দে। জয়তী সোসাইটি’র ‘ষাটোর্ধ্ব নারীসেবা কর্মসূচি বাস্তবায়ন কমিটির ব্যতিক্রমী আয়োজন ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেয় তাদের জীবনের দুঃখগাঁথা।
যশোর শিল্পকলা একাডেমিতে সকাল ১০ টায় শুরু হয় ‘মাগো তোমায় গান শোনাব..’ ব্যতিক্রমী এ অনুষ্ঠানের। পাঁচ শতাধিক বৃদ্ধা ও আমন্ত্রিত অতিথিদের অংশ গ্রহণে প্রাণাবন্ত হয়ে উঠে অনুষ্ঠান। প্রকল্পের সভাপতি নুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন,
স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক হুসাইন শওকত। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, আফিল গ্রুপের পরিচালক মাহবুব আলম লাভলু, জেলা প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা মুনা আফরিন, ৭১’র ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির যশোর জেলা শাখার সভাপতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হারুন অর রশিদ, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব এজেডএম সালেক, গ্রামের কাগজ সম্পাদক মবিনুল ইসলাম মবিন প্রমুখ। প্রকল্পের সম্পাদক অর্চনা বিশ^াস ইভার পরিচালনায় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সামাজিক ব্যক্তিত্ব সাইফুজ্জামান মজু ও শাহরিয়ার মিতুল প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য ও বিশেষ অতিথি হিসেবে জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খানের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু অন্য একটি অনুষ্ঠানের কারণে তাদের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক বয়স্কদের জন্য নিরাপদ আনন্দ আশ্রম’। গান ও নৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে। এ সময় বয়োবৃদ্ধ ও চলচ্ছক্তিহীন অনেক নারীর চোখে আনন্দাশ্রু দেখা যায়। তাদের চোখে-মুখে আনন্দ-উৎসবের ছাপ যেমন নজরে পড়ে; তেমনি ফেলে আসা দিনগুলোর নানা স্মৃতি মনে করে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও হারিয়ে যান অনেকে।
বয়োবৃদ্ধ মায়েদের শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেন সপ্ত সুরের কণ্ঠশিল্পী মামা রফিক, সৃষ্টিশীল সংগীত একাডেমির মোয়াজ্জেম হোসেন স্বপন, সুরধনীর ললিতা বিশ^াস, তরিকুল ইসলাম, আদিবা কামাল ও স্পন্দনের শরিফুল ইসলাম প্রমুখ। সুরনিকেতনের প্রেমার নেতৃত্বে নৃত্যানুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।
কণ্ঠশিল্পীদের কণ্ঠে উঠে আসে-মা বুঝি গান গাইতো আমার দোলনা ঠেলে ঠেলে, মা গিয়েছে যেতে যেতে গানটি গেলে ফেলে;-মায়ের মুখে ঘুম পাড়ানি মাসি পিসির গান না শুনলে অনেকেরই যে ঘুম আসতো না, তাও উঠে আসে শিল্পীদের কণ্ঠে।
এ সময় বয়োবৃদ্ধ মা ছাড়াও আমন্ত্রিত অতিথি ও আয়োজকদের চোখ বেয়ে পানি ঝরতে দেখা যায়। অনুষ্ঠানের শুরুতে শিল্পকলা একাডেমি ভবনে নেমে আসে এক আবেগঘন পরিবেশ। মনোমুগ্ধকর গান, নৃত্য ও আলোচনা সভা মনে করিয়ে দেয় পেছনে ফেলা আসা অতীতের নানা স্মৃতি। এ সময় বয়োবৃদ্ধ অনেক মায়ের চোখে-মুখে দেখা যায় নিঃসঙ্গ ও মানসিক দহনের শিকার হওয়ার দুঃসহ-দুর্ভাবনার চিত্র। কারোর চোখ বেয়ে পড়তে দেখা যায় আনন্দাশ্রু।
ষাটোর্ধ্ব এক মা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ছেলে-মেয়ে থাকতেও ‘এ দুয়ার, সে দুয়ার ঘুরে শেষ পর্যন্ত ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। তিনি বলেন, থাকা-খাওয়া সব না। নিঃসঙ্গতার দুঃসহ যন্ত্রণা যা সারাক্ষণ কুরে কুরে খায়। অপর এক বৃদ্ধা মা বলেন, পরিবারে জায়গা হলে অন্তত নাতি-নাতনির সাথে গল্প করে সময় কাটাতে পারতাম।
কিন্তু সব থাকতেও ভাগ্য আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছে। এ সময় তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। চোখ মুছে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, মেয়ের বাড়ি বৃদ্ধাশ্রম থেকে সর্বোচ্চ দুই-আড়াই কিলোমিটার দূরে। জামাই প্রতিদিনই শহরে যাতায়াত করে। মেয়েও শহরে কেনাকাটা করতে আসে কিন্তু এক নজর দেখতে আসে না। নাতনির বিয়ে হয়েছে যশোর শহরে। বিলাসী জীবন যাপন করে। কিন্তু দেখতে আসা তো দূরের কথা, আমার পরিচয়ও দেয় না। জয়তী সোসাইটির উদ্যোগে আনন্দিত-বলেন এই দুই বয়োবৃদ্ধ মা।