ঢাকা অফিস
পাওনা টাকা ফেরত চেয়ে গ্রামীণফোনকে চিঠি দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চাকরিচ্যুত সাবেক কর্মীরা। ২০১৫ সালে প্রাপ্ত ২০১০-১২ সালের ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডের (ডিব্লউপিপিএফ) মূল টাকার উপর বিলম্ব জরিমানা বা সুদের পাওনা টাকা চেয়ে এরইমধ্যে ৫০০ শ্রমিক চিঠি পাঠিয়েছেন। ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে চাকরিচ্যুত প্রায় ৪ হাজার শ্রমিকেরই গ্রামীণফোনের কাছে চিঠি পাঠানোর কথা রয়েছে।
শ্রমিকদের দাবি, মামলা প্রত্যাহার করায় সরকারি নিয়ম অনুযায়ী গ্রামীণফোনের কাছে শ্রমিকদের পাওনা রয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। প্রকৃত হিসাবে এই অঙ্ক আরও বেশি হতে পারে। তবে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছে।
জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের সাবেক সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার আ ফ মুস্তাছিম বিল্লাহ বলেন, ‘২০১০, ১১ ও ১২ সালে যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়, নিয়ম অনুযায়ী প্রফিটের ৫ শতাংশ তাদের দেওয়ার কথা। কিন্তু গ্রমীণফোন ওই আইনের বিরুদ্ধে রিট করে। পরে সরকার আইন পরিবর্তন করে তাতে টেলিকম খাতকেও অন্তর্ভূক্ত করে। তখন গ্রামীণফোন জানায় তারা প্রফিট শেয়ার করবে। সে অনুযায়ী তারা প্রফিটের টাকা দেয়। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী তাদের লভ্যাংশের টাকাও দিতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে তারা সেই টাকা দিচ্ছেন না। পরে সম্প্রতি আমরা আবার ওই মামলায় এডেড পার্টি হই। গ্রামীণফোন তাদের মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। তাই তাদের লভ্যাংশের টাকাও দিতে হবে। এখন আমরা গ্রামীণফোনকে প্রাপ্য টাকা পেতে চিঠি দেওয়া শুরু করেছি। গেল কয়েক দিন ধরেই চিঠি দেওয়া শুরু হয়েছে।’
গ্রামীণফোনের সাবেক কর্মী ও জেনারেল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের (জিইইউজিপি) সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইফতিয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের প্রায় ৩৮০০ শ্রমিকের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০০ শ্রমিক চিঠি পাঠিয়েছেন। পাওনা টাকা চেয়ে চাকুরিচ্যুত বাকি শ্রমিকরাও গ্রামীণফোনকে দ্রুত চিঠি দেবে।’
গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, “আমি, …. গ্রামীণফোন আইডি (…), ২০১০-২০১২ সাল পর্যন্ত সময়কালে আপনার কোম্পানি গ্রামীণফোন লিমিটেডের (…) ডিভিশনের অধীন (…..) ডিপার্টমেন্টে একজন স্থায়ী শ্রমিক/কর্মচারী হিসাবে (…) পদে নিযুক্ত ছিলাম। তৎকালে, ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জারি করা এবং একই সালের ৭ অক্টোবর সরকারি গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে প্রকাশিত একটি SRO No. 336- Ain/2010 এর দ্বারা বাংলাদেশের সব মোবাইল টেলিফোন কোম্পানিগুলিকে বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর ধারা ২৩৩ (১)(চ) এর অধীন Industrial Undertaking এর আওতাভূক্ত করা হয়। ফলে ২০১০ সাল থেকেই জিপিতে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের Workers Profit Participation Fund (WPPF) এবং Workers Welfare Fund (WWF) প্রাপ্য হয় কিন্তু আপনি, গ্রামীণফোন লিমিটেড Industrial Undertaking সংক্রান্ত উক্ত সরকারি গেজেটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে ৩৪৬৬/২০১১ নং রিট পিটিশন দায়ের করিলে, আদালত বিগত ২ মে, ২০১১ তারিখে একটি Rule Issue করে উক্ত গেজেটের কার্যকারীতা শুধুমাত্র গ্রামীণফোনের ওপর স্থগিত করেন এবং সেই সুযোগে আপনি আপনার শ্রমিক কর্মচারীদের প্রাপ্য WPPF এবং WWE দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, পরবর্তীতে একজন কর্মী মোহাম্মদ মইনুল কাদের উক্ত ৩৪৬৬/২০১১ নং রিট মোকদ্দমায় ৩ নং রেসপনডেন্ট হিসেবে পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন করিলে ১৫ এপ্রিল, ২০১৩ তারিখে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে উচ্চ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন মঞ্জুর করেন। পরবর্তীতে মূল মোকদ্দমাটির Rule শুনানি শেষে উচ্চ আদালত পাওনা পরিশোধের নির্দেশ দেন। যে কারণে ২০১৪ সালের ২৪ জুলাই, গ্রামীণফোন লিমিটেড ২০১০-২০১২ সালের WPPE এবং WWF এর সুদ ছাড়া মূল পাওনা GP WPPF & WWF Board of Trustees কে দেওয়ার পর ২০১৫ সালে শ্রমিক-কর্মচারীগণ সেই পাওনা প্রাপ্ত হন।
কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও ২০১০-২০১২ সালের WPPF & WWF এর সুদ বিলম্ব জরিমানার বিষয়টির নিষ্পত্তি না হওয়ায় পরবর্তীতে আমাদের সহকর্মী আহমদ মঞ্জুরুদ্দৌলা, মীর ইফতিয়ার হোসেন, আ ফ ম মোস্তাছিম বিল্লাহ এবং মো. জসীম উদ্দিন ৩৪৬৬/২০১১ নং রিট মোকদ্দমায় ৫-৮ নং রেসপনডেন্ট হিসেবে পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে উচ্চ আদালত বিগত ১৪ নভেম্বর, ২০১২ তারিখে উক্ত পক্ষভুক্ত করেন। এরপর গ্রামীনফোনের দায়ের করা রিট মোকদ্দমাটি ৬ মার্চ, ২০২৩ সালে প্রত্যাহার করা হয়। এর ফলে ৭ অক্টোবর, ২০১০ সালের প্রকাশিত Industrial Undertaking সংক্রান্ত সরকারি গেজেট মেনে নেওয়া হয়েছে, বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর সংশ্লিষ্ট ধারা ও উপধারা অনুযায়ী ২০১০-২০১২ সালের WPPF এবং WWF এর মূল টাকা বিলম্বে দেওয়ায় যে সুদ/বিলম্ব জরিমানা প্রাপ্য হয়, হিসাব নিকাশ করে তা আবেদন প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে আমাকে (সংশ্লিষ্ট চিঠির প্রেরক) বুঝাইয়া দিতে, কার্যকর ব্যাবস্থা গ্রহনে আপনার মর্জি হয়।’
প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে গ্রামীণফোনের সাবেক কর্মী ও জেনারেল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের (জিইইউজিপি) সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইফতিয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গ্রামীণফোন এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন গঠন করি ১২ সাল থেকে। তখন একটি গণছাঁটাই হওয়ার পর ইউনিয়নের কার্যক্রম শুরু হয়। ইউনিয়ন গঠনের পর ডোনেশন ও মেম্বার কালেকশন শুরু করি। তিন বছর করার পর ইউনিয়নের লিডারদের প্ররোচিত করার চেষ্টা করে। ইউনিয়নের নেতারা বিক্রি হয়ে যায়। ইউনিয়নের কাজ হচ্ছে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করা, তারা গ্রামীণফোনের স্বার্থ রক্ষা করার কাজে নেমে যায়। ইউনিয়নের কোন কাজ না করে তারা গ্রামীণফোনকে সাহায্য করছিলো। তারা তিন টার্ম পিপলস কাউন্সিল চালানোর পর তা বন্ধ করে দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের কর্মীরা বেশিরভাগ টেকনোলজি বেইজড। আমরা নেটওয়ার্কের কোয়ালিটি মেইনটেইন করতাম। তারা টার্গেট করে একটা প্রজেক্টের নাম দিলো কমন ডেলিভারি সেন্টার। ৬৫৩ জন মানুষের চাকরি খাওয়ার জন্য একটি প্রজেক্ট তৈরি করলো। তার মধ্যে আমার নামও ছিল। এই ছাঁটাই করতে পারলে আর এই ইউনিয়নটা থাকবে না। এই ইউনিয়ন না থাকলে গ্রামীণফোনের আর ঝামেলা নাই। তখন আমরা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করলাম। ছয় মাস আমরা আন্দোলন করলাম। ছয় মাস পরে তারা প্রজেক্ট থেকে বের হয়ে এলো। জানালো এই প্রজেক্ট তারা করবে না। ৬ মাসের পর ৩ মাস স্বাভাবিকভাবেই চলতেছিল। ইউনিয়ন দুটি দুইভাগে, গ্রামীণফোনের মানুষও দুই ভাগে। এসময় ২০১৯ সালের জুলাইয়ে আমাদের টার্মিনেট করে দিলো, যাতে আমরা ভেতরে না থাকতে পারি।’
মীর ইফতিয়ার হোসেন আরও বলেন, ‘আমাদের বৃহস্পতিবার রাতে টার্মিনেট করেছে, রোববার দিন তো আমাদের যেতে হবে। রোববার যাতে আমরা না ঢুকতে পারি পুরো জিপি হাউজ আউটসোর্সিংয়ের লোকজন দিয়ে ঘেরাও করে রাখে। আমাদের ছবি টানিয়ে রাখে, মেইল করা হয়, যাতে আমাদের কেউ হেল্প না করে। যদি কেউ আমাদের হেল্প করে তাদের চাকরি চলে যাবে। ফলে রোববার দিন মানুষ আর নিচে নামেনি, চার-পাঁচজন নেমেছিলো, পরে তাদেরও সমস্যা হয়েছে। পরে আমরা ওই দিন ব্যাক করি। পরে আমরা মামলা করি। ওই মামলা এখনও চলমান। আশা করছি, আমরা মামলাটা জিতবো, আমাদের হারার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ ৩৩ ধারার মামলায় গ্রামীণফোন কখনও জিততেই পারে না। আমি সাংগঠনিক সম্পাদক ও আমার ইউনিয়ন আদালতে পেন্ডিং। আদালতে আমরা ট্রেড ইউনিয়ন পেন্ডিং থাকা অবস্থায় আমরা চাকরি খাওয়া তো দূরের কথা, আমাকে ট্রান্সফার করারও রাইট রাখে না, নিয়ম অনুযায়ী।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১০, ১১, ১২ তে আমাদের পাওনা টাকা ছিলো সরকারের গেজেট অনুযায়ী। এই টাকাটা তারা আটকে রেখেছিলো একটি রিট করার মাধ্যমে। রিট-৩৪৬৬, ২০১১। সরকার গেজেট পাশ করে, তারা গিয়ে রিট করে। সরকার যে গেজেট পাশ করে, গ্রামীণফোন জানায় তারা এই গেজেটের আওতাভূক্ত না। এক বছর যাওয়ার পর সরকার তার আইন সংশোধন করে। ওইখানে বলে দেয় কমিউনিকেশন সেক্টর এর আওতায় পড়বে, তখন আর গ্রামীণফোনের করার কিছু নেই। তবে তারা মামলা উঠায় নি। যে এডেড পার্টি ছিলো তাদের কিনে ফেলেছে, ফলে মামলা চালানোর কেউ ছিলো না। ওই রিটে গ্রামীণফোন ইনটিরিম একটা আবেদন করে, আমাকে ১০, ১১, ১২ এর আসল টাকাটা ডিসবার্স করার অনুমোদন দেওয়া হোক। ইন্টারেস্টের টাকাটা মওকুফ করা হোক। রিটের বিপরীতে তারাই এই আবেদন করে। কোর্ট গ্রামীণফোনকে তখন জানায় তুমি আসল টাকা দিয়ে আসো, ইন্টারেস্টের টাকার বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে। শুনানির পরে যদি কনসিকোয়েন্স গ্রামীণফোনকে ভোগ করতে হবে। ২০১৪ সালে আমাদের আসল টাকা দিলো, আমরা নিয়ে নিলাম। সেই টাকা দেওয়ার সময়, চেক দেওয়ার সময় একটা আন্ডারটেক রাখলো। আন্ডারটেকটা এমন যে আপনাকে পড়তে দিলো না, বললো আপনি সাইন করুন, চেক নিয়ে যান। ট্রাই পার্টি এগ্রিমেন্ট থাকলে কি হয় তিনজনের কাছেই এগ্রিমেন্টের কপি থাকে, আমাদের কোন কপিও সরবরাহ করা হয়নি। এটাতে ল’তে বলে বয়েড। আপনি সাইন নিলেও আইনে আপনি টিকবেন না। আমি যদি ক্লেইম করি তাহলে আমরা জিতবো। এর পরে সম্প্রতি আমরা অনুধাবন করি, এই মামলা আমাদের চালানো দরকার। সরকার শ্রমিকদের পক্ষেই দিয়েছে। এডেড পার্টি হওয়ার জন্য আমরা চার জন আবেদন করি। গ্রামীণফোন চার পাাঁচবার সময় নিয়ে, অর্থাৎ বাঁধা দিয়েছে, ওই কথাও বলেছে সাইন করে টাকা নিছে, তারা মাফ করে দিয়েছে। কোর্টে তো এটা টিকে না। তখন কোর্ট আমাদের এডেড পার্টি করে রায় দেয়। আমরা মামলার শুনানিতে চলে গেছি। শুনানির জন্য ডেটও দেওয়া হয়, ৯ মার্চ। গ্রামীণফোনকে এফিডেফিট ইন অপজিশান দিতে হয়, সেটি সাবমিট করেছি ৬ মার্চ। সকালে গিয়ে তারা আবেদন করে রিট ইউথড্র করে নেয়, কোর্ট সেটা একসেপ্ট করেছে।’
মীর ইফতিয়ার হোসেন বলেন, ‘গ্রামীণফোন যেহেতু মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে, কোর্ট মৌখিকভাবে জানিয়েছে যেহেতু গ্রামীণফোন এতো বড় কোম্পানি তারা শ্রমিকদের টাকা দিয়ে দেবে। তবে এটা অর্ডারে আসেনি। গ্রামীণফোন যে রিট উইথড্র করেছে, তার মানে তারা সরকারের গেজেট মেনে নিলো। ২০১০, ১১, ১২ এর যে ইন্টারেস্টের টাকাটা আছে তা আমরা পাবো। আমাদের প্রায় ৪ হাজার শ্রমিক। ওদের একটা হিসাবে ইন্টারেস্টের টাকা ২ বিলিয়ন ডলারের মতো, মানে ২১ হাজার কোটি টাকা। আমাদের হিসাবে এই টাকা আরও বেশি হতে পারে। ওরা টেলিনরভিত্তিক, যতোদূর শোনা, আমার কাছে কোন ডকুমেন্ট নেই। গ্রামীণফোন বিক্রির পাঁয়তারা চলেছে। জিও, যেটা ইন্ডিয়ান কোম্পানি, তাদের কাছে বিক্রির কথা চলছে। তারা অনেক দূর এগিয়েছে। তারা অ্যাসেট ভ্যালুও করে ফেলেছে। এই তথ্যটা শোনা যাচ্ছে। ২ বিলিয়ন ডলার তাদের এসেসমেন্ট এসেছে। এই টাকাটা সব শ্রমিক পাবে, মানে আমাদের শ্রমিক ৩৮০০ এর কিছু বেশি, তখন যারা শ্রমিক ছিলো পারমানেন্ট, তারা সবাই ওই টাকা পাবে।’