মুদি দোকানিদের বাকি বিক্রিতে অনীহা
বিপাকে পড়েছেন নিম্নবিত্তের মানুষ
পরিমাণে কম কিনে সংসার চালানোর চেষ্টা অনেকের
কোম্পানিও দোকানে পণ্য দিচ্ছে না বাকিতে
আবদুল কাদের: খাদ্য ও নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে ভোক্তা কেনাকাটার ধরণ পাল্টে ফেলছে। অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাইরে কেনাকাটা কমিয়ে দিচ্ছেন। কিছু নতুন ক্রেতা বাকি নেওয়ার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে বিক্রেতারাও বাকিতে পণ্য বিক্রি কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। তবে পুরনো ক্রেতাদের জন্য বন্ধ করতে পারছেন না। কোনো কোনো বিক্রেতা আবার পুরনো বাকি তুলতে না পেরে বাকি দেওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিচ্ছেন।
যশোর শহরের বড় বাজার, চুড়িপট্টি, বাড়ান্দিপাড়া, নিউমার্কেট, রেলস্টেশন বাজার, চুয়াডাঙ্গা বাস স্ট্যান্ড বাজার, তালতলা বাজারগুলো ঘুরে ২৫ টির অধিক খুচরা দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন কিছু ক্রেতা খুব হিসেব করে পণ্য কিনছেন। বড় সাবানের বদলে ছোট সাবান, কাপড় ধোয়ার গুড়া সাবানের বড় প্যাকের বদলে ছোট প্যাকেট, শ্যাম্পুর বোতলের বদলে কিনছেন মিনিপ্যাক, সয়াবিন তেল কিনছেন কম পরিমাণে। চাল, তেল, চিনি, আটা, ময়দা, পেঁয়াজ, রসুনসহ নিত্যপণ্য যেটুকু না কিনলেই নয় সেটুকুই কিনছেন।
উপশহরের বাসিন্দা স্বপন কুমার সরকার। কাজ করেন একটি কাপড়ের দোকানে। পাঁচ সদস্যের পরিবার তার। বেতন না বাড়লেও এক মাসের ব্যবধানে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়ায় সংসার খরচ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন তিনি। আক্ষেপ করে কল্যাণকে বলেন, আমার পক্ষে সংসার চালানো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এক বছর ধরে কাপড়ের দোকানে আছি বেতন বাড়েনি। কিন্তু বাজারে কোন কিছু কিনতে গেলে সব জিনিসের দাম বেশি। কীভাবে যে চলবো..।
শহরের বড় বাজারের মুদি দোকানি আশিষ সাহা কল্যাণকে বলেন, প্রতিমাসে আমার বাকিতে পণ্য বিক্রি করতে হয় অন্তত লাখ টাকার। তবে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি অস্বাভাবিক। আগে কয়েকটি কোম্পানি বাকিতে পণ্য দিলেও এখন দিচ্ছেনা। সব জিনিসের দাম বাড়ায় পুঁজি লাগছে বেশি। আবার বিক্রিও কমে গেছে। এতে আর বাকিতে পণ্য বিক্রি করতে পারছি না। তবে খুব কাছের লোকদের কিছু মাল বাকিতে দিচ্ছি। বাকিতে পণ্য না দেবার কারণে বিক্রি কমে গেছে। এতে দুর্দশায় আছি। ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
পাশের আরেক মুদি দোকানি রবিউল আলম বলেন, চাল, ডাল, তেল, আটা-ময়দা, মশলার দাম অনেক বেশি। এ কারণে মহাজনরা বাকি দিচ্ছে না। আবার পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে মানুষ চাহিদার তুলনায় কম কিনছেন। এতে নগদ টাকার জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
মুদি দোকানি ত্রিনাথ সাহা বলেন, বড় বাজারে কমপক্ষে শতাধিক মুদি দোকানি রয়েছেন। এরমধ্যে ৯০ ভাগ দোকানি কেউ বাকিতে পণ্য বিক্রি করছে না। যাদের লেনদেন খুব ভালো শুধুমাত্র তাদেরকে দেয়া হচ্ছে। না হলে ব্যবসা টিকবে না।
শুধু মুদি দোকানগুলো নয়, শহরের আবাসিক এলাকার হোটেল ব্যবসায়ী ও চা দোকানিরাও বাকিতে জিনিস বিক্রি করছে না। শহরের প্রাণকেন্দ্র হাসপাতাল মোড়ের চা দোকানি লিটন বলেন, সব বেকারি পণ্যের দাম বেড়েছে। এতে পুঁজি বেশি লাগছে। যেকারণে বাকিতে বিক্রি করলে নিজের সংসার চলবে না। যাদের লেনদেন খুব ভালো শুধুমাত্র তাদেরকে কিছু বাকি দিচ্ছি।
বেজপাড়া এলাকার দোকান কর্মচারি রাকিবুল আলম প্রতিমাসে গড়ে ৪ হাজার টাকার পণ্য নেন এলাকার মুুদি দোকানি রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে। বাকিতে কিনে মাস শেষে বেতন পেয়ে তিনি পরিশোধ করতেন ১২ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে। কিন্তু চলতি মাসে ওই দোকানি রাকিবুলকে আর বাকিতে পণ্য দেননি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কিছু কোম্পানির কাছ থেকে মুদি দোকানিরা বাকিতে পণ্য কেনার সুযোগ পেতেন। সেই সুযোগ চলতি মাস থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আবার দাম বৃদ্ধির জন্য পণ্য কিনতে পুঁজিও বেশি লাগছে। এতে দোকানি নগদ টাকার সংকটে পড়েছেন। যে কারণে বাকিতে পণ্য বিক্রি করছে না। এতে বেকায়দায় পড়েছেন রাকিবুল। নিরুপায় হয়ে এক আত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে কিনেছেন এ মাসে।
শহরের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী অটিস্টিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বপন হোসেন জানান, দাম বৃদ্ধির কারণে নিত্যপণ্যের খরচও কমাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, বাজারে যে জিনিসের দাম। এ জন্য এখন খরচের পরিমাণও কমছে। যেখানে কিনতাম এক কেজি চাল, সেখানে কিনছি আধা কেজি। কী করার উপায় নেই। না খেয়ে তো আর বাঁচা যায় না। তার উপর এলাকার মুদি দোকান থেকে কিছু জিনিস বাকিতে কিনতাম, মাস শেষে বেতন পেলে সেটি পরিশোধ করতাম। কিন্তু দোকানি আর বাকিতে পণ্য বিক্রি করছে না। কারণ হিসেবে বলছেন, সব জিনিসের দাম বাড়ার কারণে তাদের পুঁজি বেশি লাগছে, আবার কোম্পানি কোন বাকিতে পণ্য দিচ্ছে না। যেকারণে তারাও আর বাকিতে বিক্রি করছে না।
শহরের বড় বাজারের মুদি দোকানে ডিম কিনতে আসা রেল রোডের বাসিন্দা ফেরিওয়ালা এনতাজুল ইসলাম বলেন, মাংস কিনে খেতে পারি দুই তিন মাস পর পর। ডিম কিনে খাব, তার দামও প্রতি পিচে ৩টাকা বেড়ছে।
নাম প্রকাশে অনিুচ্ছুক এক সরকারি চাকরিজীবির স্ত্রী বলেন, এখন মনে হয় ২৫ তারিখে মাস হলে ভালো হয়।
এদিকে, গত এক মাসের ব্যবধানে যশোরের বাজারে ৩৩ টি খাদ্যপণ্যের মধ্যে বেড়েছে ২০টির দাম। কমেছে শুধু একটি পণ্যের দাম। স্থিতিশীল রয়েছে ১২টির। দোকানিরা বলছে, এক মাসের ব্যবধানে বাজারে মোটা চাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন, পাম অয়েল, মসুর ডাল, ছোলা, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, আদা, জিরা, তেজপাতা, গুঁড়া দুধ, চিনি ও ডিমের দাম বেড়েছে। বাজারে শুধুমাত্র কমেছে ব্রয়লার মুরগির দাম, যা গত মাসের থেকে বর্তমানে কেজিতে ৫ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে।
যেসব পণ্যের দাম তার মধ্যে সবেচেয় বেশি বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। এছাড়া বাজারে খোলা আটা-ময়দা, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, ডিম, আদা, রসুন ও আলুর দাম বেড়েছে ১০-২৯ শতাংশ পর্যন্ত। এ সব পণ্যই একটি পরিবারের জন্য প্রতিদিনের অপরিহার্য।
প্রতি কেজিতে সবজির দাম বেড়েছে ১০-২০ টাকা। গোল আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়, পটল ৩০ টাকা, বেগুন ৫০-৬০ টাকা, বরবটি ৩০ টাকা, ঢেঁড়স ২০ টাকা, শসা ৩০ টাকা ও পেঁপে ৫০ টাকায়। কাঁচা মরিচের দাম কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকায়। পেঁয়াজ ঈদের আগে প্রতি ৫ কেজি ছিল ১৩০ টাকা। গতকাল বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। রসুন ৬০টাকা ছিল যা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০টাকা। ফার্মের মুরগির ডিম প্রতি ডজন ৮৪ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩২ টাকায়।
যশোর নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, বাজার পরিস্থিতি অস্বাভাবিক, মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ছে হু হু করে। নি¤œ ও মধ্যবৃত্তরা খুবই দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। হাজার হাজার নাগরিক রয়েছেন যারা বছরের পর বছর ধরে মুদি দোকান থেকে পণ্য কিনতেন, কিন্তু হঠাৎ বেশিরভাগ দোকানগুলো বাকিতে পণ্য বিক্রি কমিয়ে দেবার কারণে বেকায়দায় পড়েছেন তারা।