কাদের আমাদের অবজ্ঞার পাত্র, সে আমাদের মুখের খাদ্য, অপুর জন্য পোলাওয়ের চিকন চাল, খাঁটি গাওয়া ঘি, শিশুর জন্য দুধ উৎপন্ন করে। ফলমূলের যোগান দেয়। তাকে আমরা কতটুকু মূল্যায়ন করি, বরং চাষা বলে গালি দেই।
সফিয়ার রহমান: অপু এবং কাদের আপন চাচাতো ভাই। দু’জনেরই বাবা অকালে পরপারে চলে গেছেন। অপু মেধাবী ছাত্র, কাদের গবর গনেশ। অপুর মা খেয়ে, না খেয়ে জমি বিক্রি করে ছেলেকে বুয়েট থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করালেন। অপু চাকরি নিয়ে আমেরিকায় চলে গেল। কাদের বাবার সম্পত্তিতে রাত-দিন পরিশ্রম করে আদর্শ কৃষক হলো। বাড়ির আঙ্গিনায় ফল ফুলের গাছে পরিপূর্ণ।
পাঁচটি বিদেশী জাতের গাভি নিয়ে একটা ডেয়রি ফার্ম করেছে। মা-ছেলে নানা কাজে ব্যস্ততার মধ্যে দিন কখন চলে যায় বুঝতে পারে না। হাজার হাজার ডলার না চাইতেই চলে আসে। তবে মোবাইলে ছেলের সাথে কথা বললেই চোখের পানি যেন বাঁধ ভাঙে। ছিল কুঁড়েঘর এখন গ্রামের মধ্যে একমাত্র তিন তলা বাড়ি, তবুও যেন সুখ খুঁজে পায় না। কাউকে অবশ্য বুঝতে দেয় না। অপুর মায়ের সুখে কেউ কেউ চোখ টানাটানি করে।
কেউ সঙ্গ দেয়, কেউ এড়িয়ে চলে। কাদেরের মার এতটুকু ফুরসৎ নেই। মাঠের ফসল, গোয়ালে গরু কোন দিকে সামলাবে। ফলমূল, তরিতরকারী, ধান-পাট, গরুর দুধ প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে নানা হাটে-বাজারে। তবে পরিশ্রমের তুলনায় মুনাফা কম, তাই কাদেরের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে ধীরে ধীরে। আবার হঠাৎ প্রকৃতির হাতে মার খেয়ে ঝিমিয়ে পড়ে। অনেক দিন পর অপু বাড়ি এল। এলাকায় সাড়া পড়ে গেল। দলে দলে লোক আসছে অপুকে এক নজর দেখতে। আর আসবেই বা না কেন? এ যে এলাকার গর্ব, এলাকার রতœ। আমেরিকার বুকে এখন বিখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী। রতœগর্ভা হিসাবে অপুর মাকে সুবিধাবাদীরা পুরস্কৃত করেছে। অপু দুহাতে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মন্দির, মসজিদে সাহায্য করছে। এই সুযোগে যত্রতত্র নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। গরিব মানুষের লাইন পড়ে গেছে বাড়ির সামনে কেউ খালি হাতে ফিরছে না। কাদেরের মা এই হাজার মানুষের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে আমার কাদেরের শরীরটা রোদে পুড়ে কালো হয়ে গেল অথচ ভাগ্যের উন্নতি তেমন হল না। অপু কি এমন করলো যার জন্য আজ তার বাড়িতে চান্দের বাজার। কেমন সে দেশ! যেখান থেকে অপু টাকার পাহাড় বয়ে নিয়ে আসছে। কি করলে তারা অপুকে এত টাকা দেয়? সাহায্যপ্রার্থীরা কাদেরের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। অপুর মা তিন তলার জানালার ধারে বসে আছে। নিচে নামলে তার চতুর পাশে ভিড় জমে যায়। তিন তলার জানালায় যেন রাজকুমারী বসে আছে। যেখান থেকে অপুর মা দেখছে দক্ষিণা বাতাসে কাদেরের মা গাছতলায় বসে মনের সুখে পান চিবুচ্ছে আর গোবরের বড়ে দিচ্ছে।
অপুর ফিরে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। মনে বড় ইচ্ছা হলো গ্রামের লোকদের একত্র করে এক বেলা ভাল খাবার দেবে। এ খবরে গ্রামময় হৈ চৈ পড়ে গেল। যথা সময়ে কোরমা, পোলাও রান্না হচ্ছে ঈদের আনন্দ যেন হার মেনেছে। ইচছামত পেট পুরে সবাই খাচ্ছে। জিলকদ মাস্টার খাওয়ার পর তেল ঘি যেন পেটের মধ্যে গুলিয়ে উঠছে। অনেক দিন পর এখাদ্য যেন পেটে মেনে নিচ্ছে না। দৌড়ে গেল কাদেরের মার কাছে পান খাওয়ার জন্য। পান চিবুতে চিবুতে জিলকদ মাস্টার পাশে বসা লোকদের প্রশ্ন করলো; বলতো এ জগতে কাদেরের মা সুখী, না অপুর মা সুখী? কে রতœগর্ভা? সবাই হেসে উঠলো। তুফান পাড় বললো, একি একটা প্রশ্ন হল মাস্টার সাব। অপুর মাই সুখী এবং রতœগর্ভা।
জিলকদ মাস্টার মাথা নাড়লেন। ধীরে ধীরে বললেন, অপু আমাদের রতœ তবে তাকে ধরে রাখতে পারিনি। দেশের সম্পদ ব্যয় করে যোগ্য করে গড়ে তুলে দিলাম অন্যের হাতে। নাকি মোহের বসে চলে গেল অন্যের হাতে। আমরা ভালো বুঝিনে। কাদের আমাদের অবজ্ঞার পাত্র তবে, কাদের আমাদের মুখের খাদ্য, অপুর জন্য পোলাও-এর চিকন চাল, খাঁটি গাওয়া ঘি, শিশুর জন্য দুধ উৎপন্ন করে। ফলমূলের যোগান দেয়। তাকে আমরা কতটুকু মূল্যায়ন করি। বরং চাষা বলে গালি দেই। কাদেরের মা তুমি জান না তুমি কত সুখি। তোমার সুখ বয়ে যাচ্ছে ফল্গুধারার মত। দেশের মানুষ তা জানে না।
এতক্ষণ এক পাগল জিলকদ মাস্টারের পাশে ঘাড় গুজে বসে ছিল। সে হঠাৎ করে বলে উঠল, তা হলে কাদেরের মা-ই সুখি।
তোর উত্তরই সঠিক। কাদেরের মাকেও রতœগর্ভা হিসাবে একটা পুরস্কার দেয়া উচিত। কিন্তু দেবে কে?