কল্যাণ ডেস্ক
বেশ কিছুদিন কথা-বার্তার পর এখন আনুষ্ঠানিকতাও সারল বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে চিঠি পাঠাল নয়া দিল্লিতে। নরেন্দ্র মোদী সরকার চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও কোনও সিদ্ধান্ত জানায়নি। ফলে শেখ হাসিনাকে ফিরতে হবেই কি না, তা স্পষ্ট নয় এখনও।
এর মধ্যেই ভারতের অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক মহেশ সচদেব বলেছেন, বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো ঠেকাতে ভারতের আদালতে আবেদন করতে পারেন শেখ হাসিনা। ৩৫ বছর ভারতের ফরেন সার্ভিসে কাজ করে ২০১৩ সালে অবসর নেওয়া এই কূটনীতিক সংবাদ সংস্থা এনএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন কথা বলেন। দেড় দশক দেশ শাসনের পর ছাত্র-জনতার এক অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এখন পর্যন্ত তিনি নয়া দিল্লিতে থাকলেও কোন মর্যাদায় তাকে রাখা হয়েছে, তা খোলাসা করেনি নয়া দিল্লি সরকার।
শেখ হাসিনার শাসনকালে ঢাকা-দিল্লির সম্পর্ক ছিল বেশ উষ্ণ। কিন্তু তার পতনের পর সেই সম্পর্ক এখন শীতলতার দিকে গড়াচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে নয়া দিল্লির সম্পর্কে টানাপড়েন সম্প্রতি উত্তেজনার দিকেও গড়ায় হিন্দু ধর্মীয় নেতা চিন্ময় ব্রহ্মচারী গ্রেপ্তার হওয়ার পর। জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতের ঘটনাগুলোর জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিচার করতে আন্দোলনকারীরা তাকে ফেরত আনার জোর দাবি জানাচ্ছিল। এর মধ্যে গণহত্যার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমে এক্ষেত্রে রয়েসয়ে এগোতে চাইলেও পাঁচ মাস পর সোমবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “বিচারিক প্রক্রিয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে (হাসিনা) ফেরত চায়- জানিয়ে আমরা ভারত সরকারের কাছে একটি নোট ভারবাল (কূটনৈতিক বার্তা) পাঠিয়েছি।”
তা পাওয়ার কথা স্বীকার করে একই দিন দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, “বাংলাদেশ হাই কমিশনের থেকে একটি নোট ভার্বাল পেয়েছি আমরা। বর্তমানে এই বিষয়ে মন্তব্য করার মতো কিছু নেই।”
মহেশ সচদেব।মহেশ সচদেব।
এর মধ্যেই এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ হতে পারে কি না, হলেও কীভাবে হতে পারে, তা ঠেকাতে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী কী করতে পারেন, তা নিয়ে কথা বলেন মহেশ সচদেব। তিনি বলেন, কাউকে ফেরত পাঠাতে ভারতের বিভিন্ন অনুরোধ যেভাবে ইউরোপের দেশগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে, তেমনি নয়া দিল্লিও ঢাকার এই অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে পারে।
শেখ হাসিনা নিজেও এক্ষেত্রে সক্রিয় হতে পারেন বলে মনে করেন মহেশ। তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা আদালতে যেতে পারেন। বাংলাদেশে ফেরত পাঠালে সেখানে তিনি অবিচারের শিকার হতে পারেন।” বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণের চুক্তি আছে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ই ২০১৩ সালে চুক্তিটি হয়। ২০১৬ সালে সেটি সংশোধনও হয়েছিল।
রাজনৈতিক বিষয়াবলি এই চুক্তির আওতায় পড়ে না। তবে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে হত্যার মতো ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগও রয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য ফেরত পাওয়ার কথাই বলা হয়েছে। মহেশ সচদেব বলেন, এক্ষেত্রেই শেখ হাসিনা আদালতে গিয়ে বলতে পারেন যে বাংলাদেশে তাকে হটিয়ে যে সরকার এসেছে, তাদের সময়ে তিনি ন্যায়বিচার পাবেন না।
শেখ হাসিনার জন্য লাভ?
বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে যে কূটনৈতিক বার্তা দিয়েছে, তাতে তার লাভও হতে পারে বলে মনে করেন মহেশ সচদেব। তার মতে, এর ভিত্তিতে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করতে পারেন ভারত সরকারের কাছে। তাতে মোদীর সরকার তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতেও পারে।
মহেশ সচদেব বলেন, শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর তাকে ফেরত দেওয়ার কথা বিভিন্নভাবে বলা হলেও তার কোনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না, এখন একটি আনুষ্ঠানিক পত্র পাওয়া গেল। এই চিঠিতে আবার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, তা স্পষ্ট করা হয়নি। ফলে তা ধরে শেখ হাসিনা ন্যায়বিচার না পাওয়ার বিষয়টি সামনে আনতে পারেন বলে মনে করেন মহেশ।
আবার কূটনীতির পরিভাষায় ‘নোট ভারবাল’কে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন না তিনি। মহেশ বলেন, কূটনৈতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ‘নোট ভারবাল’ খুবই সাধারণ একটি বিষয়।
“এটা দুই সরকারের খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের যোগাযোগের ব্যবস্থা। এটা এমন যে রেকর্ড রাখার জন্য করা হয়ে থাকে। যেমন কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কেউ যাচ্ছেন, তা জানিয়ে একটা নোট ভারবাল দেওয়া হয়ে থাকে, যেন অন্য দেশের সরকার তার দিকে খেয়াল রাখে।” যদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়, তাহলে ‘কূটনৈতিক পত্র’ দেওয়া হয়ে থাকে বলে উল্লেখ করেন দীর্ঘ কূটনৈতিক ক্যারিয়ার পেরিয়ে আসা মহেশ, যা শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে দেয়নি বাংলাদেশ সরকার।
তিনি মনে করেন, ড. ইউনূসের সরকার এক ধরনের কৌশল থেকে এই ‘নোট ভারবাল’ দিয়েছে। কারণ বাংলাদেশে যেহেতু শেখ হাসিনাকে ফেরত নেওয়ার দাবি রয়েছে, তখন সরকার বলতে পারবে যে তারা কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক পাসপোর্ট হারানো শেখ হাসিনা কত দিন ভারতে থাকতে পারবেন, সেই প্রশ্নে মহেশ সচদেব বলেন, এটা আসলে পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়, এর কোনও সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন নেই। কদিন আগেই সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের রাশিয়ায় আশ্রয় পাওয়ার কথা বলেন তিনি।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যদি বাংলাদেশের আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিও থাকে, তা যে তাকে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে, সেটা মনে করেন না মহেশ। দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে আসা এই কূটনীতিক দেখাচ্ছেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানায়ও কোনও কাজ হয়নি।
“এটা আসলে অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। আর ওপরে-ওপরে যা ঘটে, তার চেয়ে ভেতরে-ভেতরে কী ঘটে, তার ওপরই নির্ভর করে এসব বিষয়।” শেখ হাসিনাকে দিল্লির লুটিয়েন্স বাংলো এলাকার একটি সুরক্ষিত সরকারি বাড়িতে রাখা হয়েছে। সেখানে তিনি সরকারি প্রটোকল পাচ্ছেন বলেও ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট জানিয়েছিল। তবে এবিষয়ে ভারত সরকার কখনও কিছু বলেনি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ছয় বছর ভারতেই নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।