“দেখা যাচ্ছে ঠাণ্ডা মাথার এক ভয়ানক খুনি এই ওসি প্রদীপ। তার চলনবলনেও দাম্ভিকতা। ধরাকে সরা জ্ঞান করতেই তিনি। এলাকায় তার কথাই ছিল শেষ কথা। যাকে খুশি গ্রেফতার করতেন, ক্রসফায়ারে দিতেন। ধর্ষণ- নারী নির্যাতনেরও বিস্তর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। অপরাধের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তিনি। অথচ অপরাধ দমন করাই ছিল তার কাজ”
ড. হারুন রশীদ: মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার রায়ে ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকতের ফাঁসির দ- দিয়েছেন আদালত। এছাড়া ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়েছে। আদালত বলেছেন, হত্যাকা-টি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল আজ সোমবার এ রায় ঘোষণা করেন।
মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার রায় স্বস্তিদায়ক। এই রায়ে প্রমাণ হলো অপরাধী যত শক্তিশালীই হোক পার পেয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’-এই কথাটিও যেন আবার উচ্চারিত হলো। প্রদীপের নিচে অন্ধকার কথাটি আমরা জানি। ওসি প্রদীপ আলো হয়ে না জ্বলে অন্ধকারকেই ঘনীভূত করেছেন!
পুলিশের কাজ হচ্ছে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু সেই পুলিশ যখন মানুষের জীবন কেড়ে নেয় সেটি এক ভয়ানক ব্যাপার। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকা-টি তেমনই এক মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। কিছুদিন আগেও যিনি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন এসএসএফ সদস্য হিসেবে। সেই তাকেই কি না প্রাণ দিতে হলো পুলিশের হাতে। বিনা অপরাধে। প্রকাশ্যে।
পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত খুব কাছ থেকে মেজর (অব.) সিনহাকে গুলি করেন। তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য পা দিয়ে গলা চেয়ে ধরেন ওসি প্রদীপ। অনেক পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। হত্যাকা- জায়েজ করার জন্য সাজানো হয় ডাকাতি নাটক। মাদক উদ্ধারের নামেও চলে অপতৎপরতা। দেখা যাচ্ছে ঠান্ডা মাথার এক ভয়ানক খুনি এই ওসি প্রদীপ। তার চলনবলনেও দাম্ভিকতা। ধরাকে সরা জ্ঞান করতে তিনি। এলাকায় তার কথাই ছিল শেষ কথা। যাকে খুশি গ্রেফতার করতেন, ক্রসফায়ারে দিতেন। ধর্ষণ-নারী নির্যাতনেরও বিস্তর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। অপরাধের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তিনি। অথচ অপরাধ দমন করাই ছিল তার কাজ।
সিনহা হত্যার ঘটনার এক মাসের মাথায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেয়। তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেন। প্রতিবেদনে সিনহা হত্যাকা-কে পুলিশের হঠকারী (অবিমৃশ্যকারী), প্রস্তুতিহীন ও অপেশাদারি আচরণ বলে উল্লেখ করে তদন্ত কমিটি।
আমরা এই হত্যাকা-ের প্রেক্ষাপটটি একটু দেখে আসি। জাগো নিউজের এ সংক্রান্ত খবরে বলা হয়েছে, ‘২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা। পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এ কর্মকর্তা।
হত্যাকাণ্ডের চারদিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে হত্যা মামলা করেন। মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ নয়জনকে আসামি করা হয়।
মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি। মামলার তিন নম্বর আসামি বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে কর্মরত উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত। আদালত মামলাটির তদন্তভার দেন কক্সবাজারের র্যাব-১৫কে।’
কথায় আছে, কচু কাটতে কাটতে মানুষ কাটা শিখে ফেলা হয়। ওসি প্রদীপের দায়িত্ব পালনকালে ক্রসফায়ারের নামে দেড় শতাধিক হত্যাকা- ঘটে। যার কোনো কোনোটি দেশব্যাপী তুমুল আলোচনায় আসে। স্থানীয়রা গণমাধ্যমে অভিযোগ করে বলেছেন, ‘অপরাধ করতে করতে প্রদীপের পাপের বোঝা ভারী হয়ে আসছিলে। সিনহা হত্যাকা- তার সব পাপকে সামনে নিয়ে এসেছে। না হলে তার ত্রাসের রাজত্ব চলতেই থাকতো।’
ওসি প্রদীপ অনেক মায়ের কোল খালি করেছেন, অনেক স্ত্রীকে করেছেন বিধবা, হত্যা-ধর্ষণসহ গুরুতর সব অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। একজন থানা পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা এত এত অপরাধ করছেন দিনের পর দিন সেটি কি দেখার কেউ ছিল না? ঊর্ধ্বতনরা কি ওসি প্রদীপের অপরাধের দায় এড়াতে পারেন? বিশেষ করে ওসি প্রদীপ-লিয়াকতের মতো পুলিশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারীদের দেখার কি কেউ নেই? এদের শুরুতেই থামিয়ে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে ওসি প্রদীপের মতো পুলিশ বাহিনীতে থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাদের ব্যাপারেও কড়া নজরদারি বজায় রাখতে হবে।
পুলিশের কাজ হচ্ছে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। মানুষের জানমাল রক্ষায় তারা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে এটিই কাম্য। কিন্তু দেখা গেল লোভের কারণে বিপথগামী হচ্ছেন তারা। এর চেয়ে জঘন্য অপরাধ আর কি হতে পারে। আর সেটি যদি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো কোনো সুশৃঙ্খল বাহিনী করে তাহলে তা আরও আতঙ্কের ব্যাপার।
পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশকিছু কথা বলেছিলেন, যা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকার সর্বদাই পুলিশ বাহিনীর উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে আন্তরিকভাবে কাজ করেছে। আমরা মনে করি, দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা, উন্নয়ন, প্রগতি, জননিরাপত্তা তথা সার্বিক কল্যাণ সাধনে যুগোপযোগী পুলিশ বাহিনীর বিকল্প নেই।
বর্তমান সরকার বাংলাদেশ পুলিশের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নতুন নতুন প্রযুক্তি সংযোজন, আধুনিক প্রশিক্ষণ, জনবল বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে, যার সুফল ইতোমধ্যে দেশের জনগণ পেতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ পুলিশের সব অঙ্গনে আজ নারী পুলিশের কর্মমুখরতা প্রতিষ্ঠানটিকে আরও জনবান্ধব করে তুলেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ পুলিশের দক্ষতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ বিশ্বে ‘রোলমডেল’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশের সব প্রয়োজন ও সংকটকালে বাংলাদেশ পুলিশ জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধানে নিষ্ঠা ও পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সাফল্য ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা বাংলাদেশকে বিশ্ব পরিম-লে অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।
‘আমি আশা করি, বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্য দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জননিরাপত্তা বিধান ও জনবান্ধব পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাবেন। সেবাপ্রত্যাশী মানুষকে স্বল্পতম সময়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান করে জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করবেন। সরকারের রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নে অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করবেন’- বলেন তিনি।
এ কথা ঠিক দিন দিন পুলিশের কর্মপরিধি বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে পুলিশের সক্ষমতাও। একটি স্বাধীন দেশের পুলিশ বাহিনী জনবান্ধব হবে-এটি একটি সাধারণ প্রত্যাশা। সেখানে কিছুসংখ্যক পুলিশ সদস্যের অর্থলিপ্সা ও কুকর্মের কারণে গোটা পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এটি মেনে নেওয়া যায় না। ইংরেজি চঙখওঈঊ শব্দের বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়- চ– চড়ষরঃব, ঙ– ঙনবফরবহঃ, খ– খড়ুবষ, ও– ওহঃবষরমবহঃ, ঈ– ঈড়ঁৎধমবড়ঁং, ঊ– ঊভভরপরবহঃ। এই বহুগুণে গুণান্বিত মানবিক পুলিশই মানুষজন দেখতে চায়।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে হত্যাকা-ের ১৮ মাসের মাথায় অবশেষে রায় হলো। নিন্ম আদালতের এই রায়ই শেষ কথা নয়। এটি উচ্চ আদালতে যাবে। তারপর আপিল হবে। সবশেষ ধাপ রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা। আমরা চাই সবগুলো আইনি ধাপ অতিক্রম করে দ-প্রাপ্তদের শাস্তি নিশ্চিত হবে। সাধারণ মানুষ আর জনগণের জানমালের দায়িত্ব পালন করা পুলিশের অপরাধ এক করে দেখার সুযোগ নেই। কথা এই যে, সরকারি পোশাকধারী অপরাধীদের তৎপরতা চিরতরে বন্ধ হোক। অন্যরা এই শাস্তি থেকে শিখুক। দায়িত্বপালনে নিষ্ঠাবান হোন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।