রায়হান সিদ্দিক
পুরুষশাসিত সমাজে নারী যুগ যুগ ধরে অসহায়। নারীসত্তার প্রকৃত প্রার্থনা কী ? তা কেউ কখনও কী খোঁজ করেছে! শনিবার যশোর আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবের ৩য় দিনে জেলা শিল্পকলা একাডেমী মঞ্চে দেখা গেল অতিবাস্তবিক ধারায় প্রার্থিনী সত্তার জাগরণের মধ্য দিয়ে নারীর মনস্তত্ত্ব। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌঠান ‘কাদম্বরী’ চরিত্রকে কেন্দ্র করে নারীবাদী চিন্তার আবর্তন এই নাটকে। নাটকটি রচনা করেছেন সাধনা আহমেদ ও নির্দেশনা দিয়েছেন আইরিন পারভীন লোপা। এটি সাধনা আর্টস অ্যান্ড থিয়েটার প্রযোজনা। মঞ্চে দুই চরিত্রের অনবদ্য অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখেছে দর্শকশ্রোতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ের চার মাস পর একদিন আফিম খেয়ে তার বৌঠান কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। ইতিহাসে এ আত্মহত্যা নিয়ে নানা রহস্য রয়েছে। সাহিত্য-শিল্পে নানামুখী ভাবনাও উঠে এসেছে। প্রার্থিনী নাটকে কাদম্বরীর মনোসমীক্ষণের মধ্যদিয়ে প্রকৃত সত্তাকে খুঁজেছেন নাট্যকার। কাদম্বরী আত্মহত্যার আগ মুহূর্তে আফিমজল পান করতে গিয়ে সাজটেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। কাদম্বরীর ভেতর থেকে বের হয়ে আসে আরেক সত্তা। দুই সত্তার দ্বান্দ্বিক ঘূর্ণাবর্তে উন্মোচিত হতে থাকে নারীর বঞ্চনা, চাওয়া-পাওয়া, অস্তিত্বহীনতা, চিরায়ত নারীসত্তাসহ সে সময়ের ইতিহাস। নারীকে বন্দনা করেই নাট্যকার নাটকটি শুরু করেছেন। বর্ণনাত্মক রীতির ধারায় চরিত্রাভিনয়ে এ নাটক দৃশ্যমান।
প্রার্থিনীর মধ্যদিয়ে নাট্যকার অধিবাস্তবিক চিন্তার নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন। তাইতো নারীর চাওয়া-পাওয়া, কামনা-বাসনার সঙ্গে জীবন-মৃত্যুকেও মূল্যায়ন করতে চেয়েছেন। মঞ্চে ভারী কোনো সেট নেই। একটি দোলনা, একটি ঝুলন্ত ফুলের শাখা ও সামনে দুটো উঁচু পাটাতন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দুটো নারী চরিত্রই মঞ্চে প্রায় সারাক্ষণ উপস্থিত। অনবদ্য অভিনয় পিনপতন নীরবতায় দর্শক উপভোগ করেছেন। কাব্যিক ভারী ভারী সংলাপে যেন মূর্ত হয়ে উঠছিল নারী মানসিকতার রূপ। প্রার্থিনী গ্রিক জাদুর দেবীর আসলে লাল রঙের পোশাকে আর বেগুনি রঙের শাড়িতে কাদম্বরীর অবসাদগ্রস্তের বিধ্বস্ত চেহারা।
দুটো চরিত্রেরই সংলাপ প্রক্ষেপণ অত্যন্ত সাবলীল। স্বরের মডুলেশনের বৈচিত্র্য দেখা গেছে। ভাব প্রকাশে রয়েছে নানা সূক্ষ কাজ। নাট্যকার সাধনা আহমেদ কাদম্বরীর মুখ দিয়ে যেন চিরায়ত নারীত্বের স্বরূপ খোঁজেন পৃথিবীর প্রথম মানবীর মতো মুক্ত-অকৃত্রিম জলাভূমি। সে নিষিদ্ধ বাগানে প্রবেশের অধিকার যার জন্মগত। যেখান থেকে সৃজিত হয়েছে মানুষের ইতিহাস।
‘সংস্কৃতি জাগরুপ প্রাণ, থিয়েটার শিক্ষা অনিবার্ণ’ স্লোগানে থিয়েটার ক্যানভাসের আয়োজনে যশোর আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবের ৪র্থ দিনে প্রাঙ্গনেমোর পরিবেশনায় মঞ্চায়িত হবে হাছনজানের রাজা , ১৬ জানুয়ারি ‘পালাকারের উজানে মৃত্যু’ , ১৭ জানুয়ারি থিয়েটার ক্যানভাসের ‘লালসালু’ , ১৮ জানুয়ারি নাট্যম রেপার্টরীর “কোথায় জলে মরাল চলে” , ১৯ জানুয়ারি নাট্যকেন্দ্রের ‘পুণ্যাহ’, ২০ জানুয়ারি স্টেইজ ওয়ানের ‘শোধ’, ২১ জানুয়ারি প্রাচ্যনাটের ‘সার্কাস সার্কাস’, ২২ জানুয়ারি শান্তিপুর সাংস্কৃতিক ভারতের অংশুপট উপাখ্যান, ২৩ জানুয়ারি মনিপুরী থিয়েটারের “কহে বীরাঙ্গনা” মঞ্চায়িত হবে।
আরও পড়ুন: যশোরে ১২দিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব শুরু
