পিতামাতার দেখাদেখি ছেলেমেয়ে এবং কোন পরিবারের নাতি-পুতিরা জড়িয়েছে মাদক বেচাকেনার মতো গুরুতর অপরাধে
লাবুয়াল হক রিপন
পিতামাতার দেখাদেখি যশোরে অনেক পরিবারের ছেলেমেয়ে মাদক বেচাকেনার মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়েছেন। কোন কোন পরিবারের নাতি-পুতি এবং তাদের আত্মীয় স্বজনরাও পূর্ব উত্তরসূরিদের পথ ধরে হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবা ও গাঁজার বিক্রি করে চলেছে। শহরের চাঁচড়া রায়পাড়া, কয়লাপট্টি, ষষ্ঠীতলা, বারান্দীপাড়া এবং রেলগেট পশ্চিমপাড়ায় খোঁজ নিয়ে এ তথ্য মিলেছে।
চাঁচড়া রায়পাড়া কয়লাপট্টিতে সাহিদা ওরফে সাই দীর্ঘদিন ধরে মাদকের কারবার করছেন। মায়ের পথে পা রেখেছেন তার ছেলে হোসেন মরা। বিক্রি করছেন মাদকদ্রব্য। শুধু তাই নয় মরার স্ত্রী আসমাও এ কাজে জড়িত। মরা-আসমা দম্পত্তির ছেলে আপনও শেষমেষ মাদক বিক্রিতে জড়িয়েছেন। এছাড়া আসমা মা নাহার বেগম একই কারকার করেন।
একসময় ষষ্ঠীতলা বুনোপাড়ার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি ছিলেন হাফিজুর রহমান মরা। কয়েক বছর আগে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হন। কিন্তু তার স্ত্রী রেখা এবং ছেলে হৃদয় মাদকের কারবার ধরে রেখেছেন। যশোরে ফেনসিডিল তৈরিকারক হিসেবে নাম রয়েছে মুরগি রহিমের। তিনি নিজে কখনো কখনো পুলিশের কথিত সোর্স পরিচয় দিয়ে অন্য অপরাধীদের কাছ থেকে হিস্যা আদায় করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার স্ত্রী দুলারী, মেয়ে সুরাইয়া, সুরাইয়ার স্বামী রনি, রনির মা রওশনারা এখন এলাকায় মাদক বেচাকেনায় যুক্ত। একই এলাকার ডলারের স্ত্রী ভানু, ভানুর বোন মঙ্গলীও কারবার করেন।
এটি দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার ফল। সমাজকে এই চক্র থেকে মুক্ত করতে সচেতনতা, শিক্ষার প্রসার এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ -সবগুলোই সমানভাবে জরুরি।
-হামিদুল হক শাহীন, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, এমএম কলেজ
ষষ্ঠীতলার মর্জিনা একজন চিহ্নিত মাদক কারবারি। ছেলে রনি ও তার স্ত্রী আরিনা, মেয়ে রুনা একই কারবারে অভ্যস্ত।
সন্ধ্যা নামলেই বারান্দীপাড়া এলাকায় বিকিকিনি শুরু হয় মাদক। দূরদুরান্ত থেকে আসা ক্রেতা বা সেবীরা সেখানে নিয়মিতই ভিড় জমান। শীর্ষ কারবারি আবু তালেবের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পরে তার সম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেন ভাতিজা জাকির হোসেন টুটুল।
শংকরপুর গোডাউন মোড়ের এক সময়কার আলোচিত মাদক কারবারি ছিলেন তারেক ও তার স্ত্রী টিয়া। বিভিন্ন মামলায় জর্জরিত হয়ে তারেক তার স্ত্রীকে নিয়ে শহরতলীর কৃষ্ণবাটিতে বসবাস করেন। কিন্তু ছেলে তানভীর এখন তার পিতা-মাতার অবস্থান ধরে রেছেন।
এলাকার চাঁচড়া রায়পাড়া কয়লাপট্টির রশিদ, প্রিন্স ও তার মা জোহরার রয়েছে একটি বিশাল সিন্ডিকেট। এলাকার নাসরিন, শেফালীসহ বেশ কয়েকজনেই ওই কারবারের সাথে রয়েছেন।
রেলগেট পশ্চিমপাড়ায় রয়েছেন রিজিয়া বেগম নামে এক নারী মাদক কারবারি। তার মেয়ে ডালিম ওরফে নদী ও স্বজন রানা পরিবার পরিজন ও আত্মীয় স্বজন অধিকাংশই এই পেশায় রয়েছে। রানার মা ফাতেমা, ভগ্নিপতি টালি বাবু নিয়মিতই কারবার করছেন। ডালিম ওরফে নদী দীর্ঘদিন ধরে এই কারবার করছেন। তার মা রিজিয়া, মেয়ে মিতু, ছেলে আলামিন এবং ভাই লুতু রয়েছে তার সহযোগি। মেয়ের সাবেক স্বামী মানিক কয়েক বছর আগে ক্রসফায়ারে নিহত হন। পরে কক্সবাজারের ইমন নামে এক শীর্ষ কারবারীকে বিয়ে করেছেন। আর সেখান থেকে প্রতিমাসে লক্ষ লক্ষ পিস ইয়াবা যশোরে আসে। এছাড়া সাগরের মা রেখা এবং বাবা ফায়েক এই সকল মাদকের অবৈধ ব্যবসার মূল কারবারী। বর্তমানে রেখা মাদক বিকিকিনিতে বোমা হাতে নিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
চাঁচড়া তেতুঁলতলার একসময়কার ‘মাদক সম্রাজ্ঞী’ বেবী। তার স্বামী গেদা বড় চালানেই মাদকের কারবার করতেন। পুলিশি তৎপরতায় বর্তমানে বেবী যশোরে না থাকলেও কারবার বহাল তবিয়তে চলছে। তার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন মেয়ে পান্না ও জামাই মানিক। মানিক ও পান্না বর্তমানে শংকরপুর এলাকায় অবস্থান করছেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে মানিক পৌর কাউন্সিলর হিটার নয়নের প্রধান ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিলো। বর্তমান পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তেমন চোখে না পড়লেও শাশুড়ির মাদকের ডেরা পুরোদমে নিয়ন্ত্রণ করছেন।
যশোর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় হীরা ছিলেন চিহ্নিত মাদকের কারবারি। হীরার অবর্তমানে তার বোন মিনি মাদকের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন।
রেলগেট পশ্চিমপাড়ার আলোচিত মাদক কারবারি জোসনা। তার স্বামীও মাদক কারবারী। বাবা মায়ের পথে মাদকে জড়িয়েছেন রকিও।
একই এলাকার শহীদ ড্রাইভার ছিলেন মাদকের কারবারি। বর্তমানে শহীদ ড্রাইভার বন্ধ করলেও তার স্ত্রী হাসিনা মাদকের কারবার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার মেয়ে নাজু একই কারবার করতেন। এভাবে বংশ পরমপরায় যশোরের বেশ কয়েকটি পরিবার মাদকের কারবার করে আসছে।
যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন বলেন, মানুষের সামাজিক আচরণ, পেশা এবং জীবিকা নির্ধারিত হয় মূলত পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের থেকে। তাই এমন মূল্যবোধহীন ও নীতিজ্ঞানশূন্য পরিবার ব্যবস্থা জন্ম দেয় ও লালন করে পরবর্তী প্রজন্মের মাদক ব্যবসায়ী। এমন মাদক বেচাকেনা যখন বংশ পরম্পরায় পরিণত হয়, তখন তা কেবল ব্যক্তির নয়, পুরো সমাজের নৈতিক কাঠামোর অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। এটি দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার ফল। সমাজকে এই চক্র থেকে মুক্ত করতে সচেতনতা, শিক্ষার প্রসার এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ -সবগুলোই সমানভাবে জরুরি।
এই ব্যাপারে কোতোয়ালি থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) কাজী বাবুল হোসেন জানিয়েছেন, মাদক কারবারী যেই হোক না কেন তাকে ছাড় দেয়া হবেনা। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা দেয়া হয়েছে।
