জাহিদ হাসান
যশোর পৌর পার্ক। এই পার্কের মধ্যে রয়েছে দুটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। পার্কটির একেবারেই মাঝে চারুপীঠ যশোর। শনিবার সকালে সংগঠনটির কার্যালয়ে প্রবেশ করতেই দেখা গেল- ‘গভীর মনোযোগে কেউ জলরঙের ছবি আঁকছেন, কেউ নকশা করছেন কাগজে। অনেকে মিলে বাঁশ দিয়ে তৈরি করছেন বিশাল আকৃতির টেপা পুতুল। কাগজ কেটে ফুল, প্যাঁচা, পাখপাখালি গড়ছেন কেউ। বিভিন্ন মুখোশে দেওয়া হচ্ছে রঙের পরশ। সেখান থেকেই কানে ভেসে আসছে নাচ আর গানের। জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই বোঝা গেল পাশেই আরেক সাংস্কৃতিক সংগঠন তির্যক যশোর। সেখানে চলছে কচি কাঁচাদের গান আর নাচের মহড়া। বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে তাদের এই মহড়া। শুধু চারুপীঠ বা তির্যক নয়; বাংলা নববর্ষ-১৪৩০ উদযাপনে এমনই দৃশ্য এখন সংস্কৃতির রাজধানীখ্যাত যশোরের ৩০টির বেশি সংগঠনের কার্যালয়ে। বাংলা নববর্ষ আয়োজনকে ঘিরে শেষ মুহূর্তে ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলার সাংস্কৃতিক কর্মীরা। বর্ণিল উৎসব ঘিরে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তৈরি করেছে ভিন্ন আঙ্গিকের দাওয়াতপত্রও।
বাংলা বর্ষবরণে যশোরের ঐতিহ্য চার দশকের বেশি। করোনা সংক্রমণের কারণে ১৪২৭ ও ২৮ এই দুই বছর নববর্ষের উৎসব ছিল অনেকটা ঘরবন্দি। ১৪২৯ সনে সংক্রমণ কমলেও রমজান মাস হওয়াতে ছোট পরিসরে উৎসবে মাতে যশোরবাসী। এবারও রমজানের মধ্যে পহেলা বৈশাখ আসায় দুপুরের মধ্যেই সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে জেলা প্রশাসনের। তার পরেও পহেলা বৈশাখে বর্ণিল সাজে ঢাক-ঢোলের বাদ্যে মাততে প্রস্তুত হচ্ছে সংগঠনগুলো। প্রাণোচ্ছ্বল হয়ে উঠেছে জেলার সংস্কৃতি অঙ্গনে। বরাবরেই মতোই ঐতিহাসিক টাউন হল ময়দান থেকে সকাল ৯ টায় যশোরে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে। জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে জেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় হবে এ শোভাযাত্রা। যশোরের ৩০টির বেশি সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রায় ৫০০ সাংস্কৃতিক কর্মী উৎসবকে সামনে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উদীচী, পুনশ্চ, তীর্যক, চাঁদের হাটসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে চলছে গান, নাচ, নাটক ও গীতিনাট্যের মহড়া। মঙ্গল শোভাযাত্রার নৌকা, দোয়েল, কচ্ছপ, বড় আকৃতির সাপ, কুমির, বাঘ, পুতুলসহ নানা রঙের মুখোশ তৈরিতে ব্যস্ত চারুশিল্পীরা। জেলার চারুপীঠ আট রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং চারুতীর্থের শিল্পীদের তুলির রঙিন আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠছে শোভাযাত্রার এসব অনুসঙ্গ। এছাড়া রং তুলিতে আল্পনা আঁকার হয়েছে সংগঠনগুলোর আঙিনাপাড়াতে।
চারুপীঠের সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ বলেন, ‘দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয় ১৯৮৫ সালে যশোরে। সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মাহবুব জামাল শামীম দুই সহপাঠীকে নিয়ে যশোরে প্রতিষ্ঠা করেন চারুপীঠ। এই প্রতিষ্ঠানই মঙ্গল শোভাযাত্রার সূতিকাগার। এর চার বছর পরই ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়, যা পরে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। সামনে নববর্ষ উপলক্ষে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বিশেষভাবে উপস্থাপনের জন্য শাভাযাত্রার নৌকা, দোয়েল, কচ্ছপ, বড় আকৃতির সাপ, কুমির, বাঘ, পুতুলসহ নানা রঙের মুখোশ তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবারেই ন্যায় এবারও জাতি বর্ণ নির্বিশেষে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবো। তির্যক যশোরের সাধারণ সম্পাদক দিপাঙ্কর দাস রতন বলেন, ‘নববর্ষকে ঘিরে যশোরের যে ঐতিহ্য নিমন্ত্রণপত্র সেটি ইতোমধ্যে বিলি করা শুরু করেছি। এবার আমাদের নিমন্ত্রণপত্র হলো বাঙালির ঐতিহ্য চরকা। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে অর্ধশতাধিক কর্মী নিয়ে তারা নাচ, গান কবিতা আবৃতির মহড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন:চর্ম রোগের আধুনিক চিকিৎসা যশোরে
বরাবরের মত পৌর উদ্যানে সকাল ৭টা ১ মিনিটে উদীচী যশোরের আয়োজনে হবে প্রায় আড়াই ঘণ্টার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান খান বিপ্লব জানান, উদীচী হত্যাকাণ্ডের দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও বিচার না হওয়ায় এবারের নববর্ষ উৎসব স্লোগান করা হয়েছে- ‘বৈশাখের এই তীব্র দহনকাল-ছিন্ন করুক বিচারহীনতার জাল’। স্লোগানের সাথে মিল রেখে আমন্ত্রণ পত্রে ব্যবহার করা হয়েছে পোস্টার। বাঁশের চাটাইয়ের উপর লালকাগজে সাদা রঙে লেখা হয়েছে আমন্ত্রণপত্র। উদীচী হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যকর করার আহ্বান জানিয়ে যশোরবাসীকে আনন্দে মাতিয়ে দেবে যশোরে ‘নববর্ষ উৎসবের পথিকৃৎ’ উদীচী যশোর। এছাড়া শিশু-কিশোরসহ প্রায় তিনশ’ সংগীত, নৃত্য ও অভিনয় শিল্পী বৈচিত্র্যময় নানা আয়োজনে নববর্ষ উৎসবের ৪৮ বছরে পা রাখছে এ সংগঠন। সংগঠনের সব শিল্পীর মৌলিক পোষাক এ অনুষ্ঠান বর্ণিল করে তুলবে।
যা বাস্তবায়নে ব্যস্ত সময় পার করছে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও কলাকুশলীরা। প্রাচীন সাংস্কৃতিক সংগঠন সুরবিতান সংগীত একাডেমি যশোরের উদ্যোগে সকাল সাড়ে ছয়টায় ঐতিহাসিক টাউন হল ময়দানের শতাব্দী বটমূলের রওশন আলী মঞ্চে ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও’ স্লোগানকে সামনে রেখে নববর্ষকে আহ্বান জানানো হবে। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বিশ্বাস জানান, ‘প্রতিবছরের মত এবারও ভিন্ন আঙ্গিকে বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানানো হবে; সেই লক্ষ্যে একাডেমির শিক্ষার্থী শিল্পীদের সমন্বয়ে মহড়া চলছে। পুনশ্চ যশোর নববর্ষের প্রথম দিন সকাল ৬টা ৩১ মিনিটে মুসলিম একাডেমি প্রাঙ্গণে করবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক পান্না দে জানান, আয়োজনকে সামনে রেখে ‘বর্ষজুড়ে বাংলা থাকুক বাঙালির অন্তরে’ এমন স্লোগানে প্রত্যয় ব্যক্ত করে ইতোমধ্যে সংগঠনের সকল প্রশিক্ষণ কক্ষে চলছে মহড়া। চলছে মঞ্চের আনুসাঙ্গিক সজ্জা তৈরির উপকরণ তৈরির কাজ।
যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যের প্রতীক সার্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। আবহমান কাল ধরে বাঙালি অধ্যুষিত জনপদে সার্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক এ উৎসবটি পালিত হয়ে আসছে। রমজানের পবিত্রতা বজায় রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হবে বাংলা নববর্ষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়া শিল্পকলা ও শিশু একাডেমির উদ্যোগে হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। হাসপাতাল, কারাগারে উন্নত মানের খাবার পরিবেশন। বিভিন্ন অভিজাত বাঙালির খাবার পরিবেশন করবে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) ফিরোজ কবীর বলেন, পুলিশের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা মধ্যে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হবে। এখন পর্যন্ত কোন প্রকার অপ্রতীকর ঘটনা ঘটনার আশঙ্কা দেখছি না।
আরও পড়ুন:৩৯ বিঘা জমি নিয়ে বিরোধে মুখোমুখি ব্যারিস্টারপুত্র ও মা