ঢাকা অফিস
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রধান দুই বিরোধী রাজনৈতিক দল—বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী—এখন প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়েছে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র দুই দলই এখন পরস্পরের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ তুলছে। শীর্ষ নেতাদের ধারাবাহিক বক্তব্য, ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য এবং মাঠপর্যায়ের উত্তেজনা—সবকিছু মিলিয়ে দুই দলের সম্পর্কের টানাপোড়েন নির্বাচনি রাজনীতির সামনের সারিতে উঠে এসেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিএনপি–জামায়াতের এই বিরোধ কেবল তাত্ক্ষণিক আবেগ নয়; এর গভীরে রয়েছে আসন্ন নির্বাচনের হিসাব–নিকাশ, ভোটব্যাংক বাঁচানোর কৌশল এবং মাঠপর্যায়ের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা।
শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে তীব্র হচ্ছে উত্তাপ
সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে দুই দলের শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যে পাল্টাপাল্টি মন্তব্য করেছেন। সিলেটের বিভাগীয় সমাবেশে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান অভিযোগ করেন, “এক দল দখলদারত্ব ও চাঁদাবাজিতে জনগণের আস্থা হারিয়েছে, আরেক দলও একই পথে এগোচ্ছে।”
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারও বিএনপির বিরুদ্ধে আরও সরাসরি অভিযোগ তোলেন। তার ভাষায়—
“বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলছে। তারা ধর্মীয় মাহফিল ও ইসলামী কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে। এতে জামায়াত নয়, ইসলামকেই বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।”
অন্যদিকে বিএনপির নেতারা পাল্টা আক্রমণে জামায়াতের অতীত কর্মকাণ্ড—বিশেষ করে ১৯৭১ সালে তাদের ভূমিকা এবং সাম্প্রতিক দুর্নীতিবিষয়ক অভিযোগ—জোরালোভাবে তুলছেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক অনলাইন বক্তৃতায় বলেন,
“মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের স্বার্থের বিপরীতে অবস্থান নেওয়া একটি দল এখন বিএনপিকে দুর্নীতি নিয়ে উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করছে—এটি অযৌক্তিক।”
ঠাকুরগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন,
“জামায়াতের টিকিট কাটলেই বেহেশত মিলবে—এই মুনাফেকি থেকে সাবধান থাকতে হবে।”
বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির এই বার্তাগুলো মূলত দুই দিকেই লক্ষ্য করে দেওয়া—একদিকে জামায়াতের ভোটব্যাংকে চাপ সৃষ্টি, অন্যদিকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ কর্মীদের ‘স্বতন্ত্র পরিচয়’ রক্ষা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে বিরোধের মূল কারণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ মনে করেন, দুই দলের সম্পর্কের টানাপোড়েন অস্বাভাবিক নয়।
তার ভাষায়—
“এটা নির্বাচনি প্রতিযোগিতারই অংশ। বিএনপি ও জামায়াত এখন একই ভোটক্ষেত্রে অবস্থান করছে। জামায়াত বহুদিন বিএনপির ছায়াতলে রাজনীতি করলেও এখন স্বতন্ত্রভাবে সংগঠন বিস্তার করার চেষ্টা করছে। সেই কারণে তৃণমূলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ছে, যা বিএনপি সহজভাবে নিতে পারছে না।”
তিনি আরও বলেন—
“জামায়াত বর্তমানে নানা আসনে বিএনপির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে দ্বন্দ্ব তীব্র হওয়াই স্বাভাবিক।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজের মতে, দ্বন্দ্বের আরেকটি বড় কারণ হলো রাজনৈতিক ম্যাপের পরিবর্তন।
তিনি বলেন—
“এবারের নির্বাচনে বিএনপি–আওয়ামী লীগের প্রচলিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। বিএনপির সামনে বাস্তব প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে এসেছে জামায়াতই। এ কারণে উভয় দল পরস্পরের দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরছে।”
এ বিশ্লেষকের মতে, দুই দলই এখন ‘ট্যাগিং পলিটিক্স’-এ নেমেছে—অর্থাৎ ভোটারদের কাছে প্রতিপক্ষকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে নিজের অবস্থান শক্ত করা।
জোট থেকে বিরোধ : পেছনের ৩০ বছরের পটভূমি
স্বাধীনতার পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জামায়াত রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পায়। ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত বিএনপি জোটের অংশ ছিল এবং ২০০১ সালে মাওলানা নিজামীসহ দুজন জামায়াত নেতা মন্ত্রিসভায়ও স্থান পান।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ, আর সেই সময় থেকেই দুই দলের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। জোট ভেঙে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে উভয় দল নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পুনর্গঠনে মনোযোগী হয়।
২০২৪ সালের আগস্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করলে জামায়াত প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানায়। এটিও দুই দলের সম্পর্কে নতুন উত্তেজনা তৈরি করে।
মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্ম—দুই ইস্যুতেই প্রতিযোগিতা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই দলই মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্ম—এই দুটি ইস্যুতে নির্বাচনি কৌশল প্রয়োগ করছে।
ড. সাব্বিরের ভাষায়—
“মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তোলা বিএনপির জন্য একটি কৌশলও হতে পারে। এতে তারা আংশিকভাবে আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংকে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।”
আলতাফ পারভেজ মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করা নিয়েও সতর্ক করেন। তিনি বলেন—
“বিগত সময়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্ম—দু’টিই ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক ব্যবসায় ব্যবহার করা হয়েছে। এবারও দুই দলের বক্তব্যে এর ছাপ রয়েছে।”
তিনি আরও যোগ করেন—
“রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিংবা ১৯৯০ ও ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনারও পরিপন্থী।”
মাঠপর্যায়ে উত্তেজনা, তবে বড় ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা কম
বিএনপি ও জামায়াতের কয়েকটি এলাকায় পোস্টার ছেঁড়া, কর্মী–সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ও সীমিত সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই বিরোধ সহিংসতায় রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা কম।
ড. সাব্বির বলেন—
“এটি সহিংস রূপ নেবে বলে মনে হয় না। তবে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বক্তব্য আরও উত্তপ্ত হবে—এটাই স্বাভাবিক।”
