সরকারি হাসপাতালে দায়িত্বে আছেন খাতা-কলমে
ওয়ার্ডে রোগীদের সাথে কথা বলার সময় থাকে না
যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ইন্টার্নরাই ভরসা
শাহারুল ইসলাম ফারদিন
যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে খাতা-কলমে আছেন বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র চিকিৎসকরা। মাঝেমধ্যে ইন্টার্নদের সাথে তারাও ওয়ার্ডে রাউন্ড দেন। কিন্তু তড়িঘড়ির কারণে রোগীরা ঠিকমতো তাদের সাথে কথা বলতে পারেন না। বাস্তবে তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। রোগী ও স্বজনদের দাবি, এসব চিকিৎসকদের নজর বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। সেখানে ঠিকই রোগীকে সময় দেন। সমস্যা নিয়ে কথা বলা যায়। তাই বিপদের দিনে সরকারি হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসকরাই রোগীর ভরসা হয়ে উঠে। ‘গুরু দায়িত্ব’ হিসেবে রোগী রিসিভ করা, চিকিৎসা দেয়া, ছাড়পত্র লেখা, রেফার করা সবই করছেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা।
হাসপাতালের তথ্য মত, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটি ২০১০ সালের পর থেকে মেডিকেল কলেজের সাথে যৌথভাবে সেবা কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ হাসপাতালে কনসালটেন্ট, জুনিয়র কনসালটেন্ট, সার্জন ও মেডিকেল অফিসারের ৬৫ পদের মধ্যে ৫০ জন কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি প্রজেক্টের আওতায় ১২ জন, ডেপুটেশনে আসা ১৫ জন, অনারারি চিকিৎসক হিসেবে ১৮ জন এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হওয়ায় কলেজের আরও ৪৮ চিকিৎসক এবং ৫০ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন। চিকিৎসকদের পাশাপাশি রোগীদের সেবায় হাসপাতালে ২৩৭ জন নার্স ও তিন শতাধিক শিক্ষানবিশ নার্স কর্মরত আছেন। ২৫০ শয্যার হলেও প্রতিদিন দ্বিগুণ-তিনগুণ রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়। বহিঃবিভাগে চিকিৎসা নেন প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার রোগী। এ হাসপাতালে যশোর জেলা ছাড়াও আশপাশের জেলা থেকে রোগী আসে।
অভিযোগ উঠেছে, বর্তমানে হাসপাতাল চলছে ইনটার্ন চিকিৎসক দিয়ে। সাবেক তত্ত্ববধায়ক ডা. আবুল কালাম আজাদ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক পদে থাকাকালীন ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করা হয়েছিলো কোন ইন্টার্ন চিকিৎসক রোগীর মৃত্যু ঘোষণা দিতে পারবেন না। এছাড়া রোগীকে রেফার ও ছাড়পত্র তারা দেবেন না। কিন্তু বর্তমানে সব কিছু চলছে আগের মতোই।
প্রসঙ্গত, একজন মেডিক্যাল ইন্টার্ন হলেন প্রশিক্ষণে থাকা একজন চিকিৎসক যিনি একটি মেডিক্যাল ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
পৌর আওয়ামী লীগের নেতা এসএম ইউসুফ শাহিদ বলেন, সদর উপজেলা পরিষদের নব-নির্বাচিত চেয়ারম্যান তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু গত সোমবার মধ্যরাতে গুরুতর অসুস্থ হলে যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। রাতে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক জরুরি চিকিৎসা শেষে তাকে ওয়ার্ডে ভর্তি করেন। ইন্টার্নি চিকিৎসক এসে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে বিষয়টি অবহিত করবে বলে জানান। তবে তখন থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আসেননি। এমনকি বারবার তাদেরকে ফোন দিলেও কোন সাড়া মেলেনি। বর্তমানে সরকারি এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় রয়েছে নানা অনিয়ম। কর্মরত বিশেষজ্ঞরা শুধু খাতা কলমে রয়েছেন। বাস্তবে তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। মাঝে মাঝে ওয়ার্ড রাউন্ডে গেলেও তড়িঘড়ির কারণে রোগীরা ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। তাদের অনিয়মের কারণে রোগীরা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই অনেকেই সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে ক্লিনিকে চলে যেতে বাধ্য হন। এতে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য আরও বেড়ে যায়। শুধু তিনি নন এমন অভিযোগ হাসপাতালে ভর্তি অধিকাংশ রোগী ও রোগীর স্বজনদের। তাদের অভিযোগ, ক্লিনিক বাণিজ্য জমজমাট করার জন্য চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেন।
হাসপাতালের পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি নির্মল মন্ডল, মহিলা সার্জারী ওয়ার্ডে ভর্তি রেখা খাতুনের স্বজন এমএম কলেজের ছাত্র মুরছালিনসহ একাধিক রোগী ও রোগীর স্বজনরা জানান, হাসপাতালে নতুন কোন রোগী দেখলেই এগিয়ে আসেন ওয়ার্ডবয়, আয়া নতুবা ঝাড়ুদার। রোগীর স্বজনদের হাতে চিকিৎসা সামগ্রী কেনার স্লিপ ধরিয়ে দেন। এরপর ইনজেকশন সিরিঞ্জ, স্যালাইন, সুই সুতো নিয়ে তারাই করেন চিকিৎসা। আবার ক্যানোলা, ইউরিন ব্যাগ, খাদ্য গ্রহণের পাইপ লাগানো কাজও তারা করেন। অর্থ ছাড়া কোন কাজই করছেন না তারা।
সদরের কচুয়া গ্রামের আকলিমা বেগম পেটে ব্যাথা নিয়ে ভর্তি হন মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে। তার মেয়ে আলেয়া আক্তার বলেন, আমার মাকে মঙ্গলবার দুপুরে মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করি। ভর্তির দুইঘণ্টা পর একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক এসে কিছু টেস্ট দিয়ে চলে যান। দ্রুততম সময়ে টেস্ট করানো হয়। এরপর ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও রিপোর্ট দেখতে কোনো চিকিৎসক আসেননি। তিনি বলেন, তারা প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশেষ করে ভর্তির পর বিশেষজ্ঞ বা সিনিয়র চিকিৎসকদের দেখা পান না তারা। ইন্টার্ন চিকিৎসক ও সেবিকাদের হাতেই রয়েছে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা। আর তারা গুরুতর রোগী এলেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন অন্য হাসপাতাল বা ক্লিনিকে।
সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি আব্দুল হাই নামে আর এক রোগী বলেন, এখানে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মুখের দিকে না তাকিয়েই তার ওষুধ লেখা হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ২০ সেকেন্ড সময়ও দেন না। আবার ওই চিকিৎসককে প্রাইভেট ক্লিনিকে ৭শ টাকা ফি দিয়ে দেখালে ২০ মিনিট যাবৎ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। তিনি ক্ষেভ জানিয়ে বলেন, বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র চিকিৎসকরা হাসপাতালের পরিবর্তে ক্লিনিকে বেশি সময় দেয়ায় হাসপাতালের সেবার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন রোগী ও রোগীর স্বজনরা।
নাম না বলার শর্তে হাসপাতালের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে হাসপাতালের চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে পড়ায় চিকিৎসক, সেবিকা, কর্মচারীরা যে যা ইচ্ছা, সে তাই করছেন। সঠিকভাবে তদারকি ব্যবস্থা ও জবাবদিহিতা না থাকায় হাসপাতালে অনিয়ম বেড়েই চলেছে।
এ বিষয়ে হাসপাতালের আরএমও ডা. আব্দুস সামাদ বলেন, চিকিৎসক পাওয়া যায় না এ কথা ঠিক না। সার্বক্ষণিক ইন্টার্ন চিকিৎসক থাকেন। তারা যদি মনে করেন সিনিয়র চিকিৎসকদের প্রয়োজন তাহলে তাদের অবহিত করেন এবং তারা এসে রোগী দেখে যান। আমাদের সিস্টেম অনুযায়ী সব সিনিয়র ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগী দেখেন। কিন্তু এর ভেতর যদি পদ্ধতিগত কোনো ভুল থাকে সেটা আমরা শোধরানোর চেষ্টা করবো।