শেখ এনামুল হক দুলু, মহেশপুর (ঝিনাইদহ): মহেশপুরে বীরশ্রেষ্ঠ হামীদুর রহমান ইকো পার্কটি চালু করতে বর্তমান জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম নতুনভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। সম্প্রতি জায়গা পরিদর্শন করে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছেন।
২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলা প্রশাসন উপজেলার খালিশপুর বাজারের কপোতাক্ষ নদের পাড়ে নীল কুঠি কাছারি বাড়ির জায়গাটি বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান ইকো পার্ক করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু ৬ বছর পার হলেও তা দৃশ্যমান হয়নি। থমকে আছে এর কার্যক্রম।
কপোতাক্ষ নদের পাড়ে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ হামিদুর রহমানের নিজ গ্রাম খালিশপুর তার নামে নামকরণ করা হয়েছে হামিদনগর। এই গ্রামের নামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি সরকারি কলেজ আছে। কলেজের সাথে স্মৃতি পাঠাগার এবং এর সামনে সমাধি করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠের মায়ের। এখানে সরকারি ৩৭ বিঘা জমি আছে। গত ৬ বছরে এই ইকো পার্কের উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি হয়নি। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশাফুর রহমান এটিকে তড়িঘড়ি করে ইকো পার্ক করার ঘোষণা দেয়ার পর সরকার বা জনপ্রতিনিধিরা কোন কার্যক্রম করেনি। ইকো পার্কের কার্যক্রম ফাইল বন্দি হয়ে আছে। পরবর্তী পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুজন সরকার ইকো পার্কের বিস্তারিত প্রতিবেদন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠান। তারপরও কোন অগ্রগতি হয়নি। ২০১৯ সালে মহেশপুর ভূমি অফিসের উদ্যোগে বিভিন্ন জাতের বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছিল। কিন্তু তার কোন অস্তিত্ব নেই এখন। ইকো পার্কটি উন্নয়নের জন্য বিগত ২ জন বিভাগীয় কমিশনার স্থানটি পরিদর্শন করে কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেন। তারই আলোকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ সরকারের উর্ধ্বতন মহলে প্রস্তাবনা পাঠান। সেটিও ফাইল বন্দি হয়ে পড়ে। বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার নয়ন কুমার রাজবংশী মহেশপুর যোগদানের পর তিনি বিষয়টির প্রতি জেলা প্রশাসক মনিরা বেগমের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি গত ২৯ মার্চ ইকোপার্ক এলাকা পরিদর্শন করেন এবং পরবর্তী কার্যক্রম উদ্যোগের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশনা দেন।
এলাকাবাসী মনে করছেন পার্কটি আধুনিক মানের নির্মাণ করা হলে পর্যটকদের কাছে দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠতো। ঐতিহাসিকদের মতে, ১৮১১ সালে কোটচাঁদপুরের দুতিয়ারকাঠি কুঠির মালিক ব্রিজবেন খালিশপুরের নীল কুঠিটি স্থাপন করেন। সে সময় খালিশপুর থেকে সাগরদাঁড়ি হয়ে কলকাতা পর্যন্ত লঞ্চ চলাচল করতো। তৎকালে খালিশপুরের কুঠিটি কাছারি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কলকাতা থেকে অনেক কুঠিয়াল সাহেব নদী পথে মাঝে মাঝে কাছারি বাড়িতে আসতেন। ১৮০৫ সালে যশোর জেলায় অনেক ইংরেজ নীল ব্যবসায়ীর আগমন ঘটে এবং তারা বিভিন্ন স্থানে নীল কুঠি স্থাপন করেন। একাধিক নীল কুঠি নিয়ন্ত্রিত হতো কনসারন অফিস দ্বারা। সে সময় কাঠগড়া কনসারন অফিসের অধীন ছিল খালিশপুর নীল কুঠির। দক্ষিণমুখি কুঠি ভবনটির দৈর্ঘ ১২০ ফুট, প্রস্থ ৪০ ফুট ও উচ্চতা ৩০ ফুট। দক্ষিণ দিকে প্রশস্ত বারান্দা। ১২ কক্ষ বিশিষ্ট দ্বিতল ভবন এটি। দেয়াল ২০ ইঞ্চি পুরু। নিচের তলার থেকে ওপরের তলার কক্ষগুলি আয়তনে বড়। চুন, সুরখী ও পাকা ইটের তৈরি। ২০০ বছরের পুরনো ভবনটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। গোসল করার পাকা সিঁড়ি নদীর নি¤œ পর্যন্ত নামানো যা এখনও ভগ্নদশা অবস্থায় আছে। ১৯৯৯ সালে কলেজ এবং ২০০৭ সালে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে যাদুঘর স্থাপনের পর খালিশপুরের সুনাম বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু নীলকুঠিয়ালদের অত্যাচার নির্যাতনের মর্মান্তিক কাহিনী এ অঞ্চলের মানুষ এখনও ভুলে যায়নি। কেননা ধ্বংস প্রায় নীল কুঠি তাদের মনে অতীত নিপীড়নের কথা জাগিয়ে তোলে।
ব্রিটিশ শাসনামলে খালিশপুরে দুটি পতিতা পল্লী ছিল যার পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল ইংরেজরা। ইংরেজ সাহেবদের মনোরঞ্জনের জন্য বহু পতিতা এখানে বাস করতো। নীল কুঠির সিঁড়িতে ইংরেজরা ও পতিতারা একই সাথে গোসল করতো। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরও কিছু সংখ্যক পতিতা এখানে ছিল। ১৯৫৪ সালে স্থানীয় লোকজন তাদের উচ্ছেদ করেন।
২০০৭ সালের দিকে কুঠি বাড়িটি নিলাম দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। এ সময় স্থানীয় জনতা ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও মানবাধিকার সংগঠন আরডিসি মিলে মানববন্ধন করে গণমাধ্যমের সহায়তায় সে সময় নিলাম থেকে রক্ষা করা হয়। মহেশপুর উপজেলার নির্বাহী অফিসার অজিয়ার রহমান তৎকালীন প্রতœতত্ব বিভাগের কাছে কুঠি বাড়িটি সংরক্ষণ করার জন্য পত্র প্রেরণ করেন। সম্প্রতি প্রতœতত্ব বিভাগ নীল কুঠিটি সংস্কার করবে বলে জানা গেছে। এই ঐতিহাসিক স্থানটিকে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান ইকো পার্ক করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।