চড়া খাজনা আদায়
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: এক বেলার বাজার। বেশিরভাগ দোকান বসে ফুটপাতে। বাদ পড়েনি পবিত্র কবরস্থানের প্রাচীর ঘেঁষা ফুটপাতও। গোরস্থানের সামনে ড্রেনে বসে ৬০টির বেশি সবজিসহ ফলমূলের দোকান। এদেরকে দিতে খাজনাসহ অতিরিক্ত টাকা। দোকান বসুক আর না বসুক-মাফ নেই এসবের কোনো কিছুর। আর এর উসুল বিক্রেতারা তুলে নেন ভোক্তার পকেট থেকে। ফলে বাড়তি দামে ভোক্তাদের কিনতে হয় পণ্য। এ চিত্র যশোর শহরের বেজপাড়া তালতলা বাজারের।
প্রচলতি একটি প্রবাদ আছে ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’ কিন্তু ছোট্ট এই বাজারের চিত্রটা পুরো ভিন্ন। এখানে বাজনার চেয়ে খাজনাই বেশি। বাজারটিতে সরেজমিনে গেলে চাঞ্চল্যকর এই তথ্য মেলে বিভিন্ন সূত্রে।
বাজার কমিটির হিসেবে তালতলা বাজার ঘিরে স্থায়ী-অস্থায়ী দোকানের সংখ্যা ২২২। এর মধ্যে রয়েছে ৪৬টি মাছের ও ১৮টি মাংসের দোকান। এর বাইরে শাক-সবজি ও ফলমূলের আরও ২০-২২টি দোকান রয়েছে। সবাইকে দোকান ভাড়া দিতে হয়। দিনের খাজনা আদায় করা হয় ৪০ টাকা। তারপর গোরস্থান ও মসজিদের উন্নয়নের নামে নেয়া হয় ১০ টাকা। নৈশ প্রহরী ও সুইপারের নামেও আদায় করা হয় বিভিন্ন অংকের টাকা। স্থানীয় প্রভাবশালী চক্রের নানা দাবি মেটাতেও প্রস্তুত থাকতে হয় বেচাবিক্রির প্রতিষ্ঠান মালিকদের। বাজার ছোট হলেও এখানে বছরজুড়ে ঘাটে ঘাটে চলে নিরব চাঁদাবাজি।
ফুটপাতের এক সবজি বিক্রেতা জানান, একদিন দোকান বন্ধ রাখলেও খাজনা মাফ নেই। তারমতো সব দোকানিকে একইভাবে খাজনাসহ নানাখাতে টাকা গুণতে হয়। গোরস্থানের সামনে ড্রেনে বসে ৬০টির বেশি সবজিসহ ফলমূলের দোকান। ফল বিক্রেতা মধ্য বয়সী নারী আকলিমা জানান, খাজনা বাদেও গোরস্থানের জন্য ১০ টাকা দিতে হয়।
স্থানীয়রা জানান, ২০-২৫ বছর আগে স্থানীয়দের উদ্যোগে মুদি ব্যবসার পাশাপাশি একবেলার বাজার বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। শাক-সবজি দিয়ে শুরু হয় বাজারের যাত্রা। নারী-পুরুষ সবাই নিজ মহল্লার বাজারে কেনাকাটা শুরু করেন। পরে মাছ-মাংসের দোকানও বসতে শুরু করে। বর্তমানে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাজারটি থাকে জমজমাট। খাজনাসহ বিভিন্ন খাতে দুটি গ্রুপের লোকজন টাকা আদায় করে। যুবলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম জুয়েলের অনুসারী নামে পরিচিত বুনোপাড়া রোডের আলোচিত আসাদুজ্জামান আসাদের ভাই সাঈদ ও রনিসহ ৪-৫ জন। অপরদিকে স্থানীয় কাউন্সিলর সায়েদ হোসেন নয়নের অনুসারী নামে পরিচিত বেজপাড়া পানির ট্যাঙ্কি এলাকার হানিফ, আকাশ ও সাজ্জাদসহ আরও ৫-৬ জন খাজনাসহ বিভিন্ন খাতে টাকা আদায় অব্যাহত রেখেছেন। এনিয়ে বাজারজুড়ে রয়েছে উত্তেজনা।
কবরস্থানের সভাপতি অ্যাডভোকেট শরিফুল ইসলাম মিলন। সেই পরিচয়ে প্রায় ৬০টি দোকান থেকে দিনে ১০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। তার অনুসারীরা চাঁদা আদায় করে। অভিযোগ অস্বীকার করে অ্যাডভোকেট শরিফুল ইসলাম মিলন দৈনিক কল্যাণকে জানান, পৌরসভা ইজারা দেয়ার পর বাইরের কারোর এ সুযোগ থাকে না। আমারও নেই। পুরো বিষয়টি মিথ্যাচার।
বাজার কমিটির যুগ্ম সম্পাদক কামরুজ্জামান সোহেল জানান, বাজারের নিয়ন্ত্রণ বাজার কমিটির হাতে নেই। বাজারে শান্তি-শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রশাসনসহ পৌর কর্তৃপক্ষের দৃশ্যমান কোন তৎপরতা নেই। খাজনার চার্টও দেয়নি পৌর কর্তৃপক্ষ। যেকারণে ইজারাদারের লোকজন তাদের ইচ্ছে মতো খাজনা আদায় করছেন।
যশোর পৌরসভার সচিব আজমল হোসেন জানান, পৌর এলাকায় যেকোন বাজার ইজারা দেয়ার এখতিয়ার পৌর কর্তৃপক্ষের রয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান থেকেও খাজনা আদায়ের অধিকার রাখে পৌর কর্তৃপক্ষ। তিনি বলেন, বাজার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পৌরসভার সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। সুইপার থেকে বৈদ্যুতিক সুবিধা পৌরসভা দেয়। আর খাজনা নির্ধারণ করেন ইজারাদার।
তিনি বলেন, এবছর বেজপাড়া তালতলা বাজার ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৬০ টাকায় ইজারা পেয়েছেন ওহি ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান। যার সত্ত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম জুয়েল।
এ ব্যাপারে শফিকুল ইসলাম জুয়েল বলেন, জানুয়ারি মাস থেকে খাজনা আদায় শুরু হয়েছে। বাজারটির ইজারা নিয়েছিলাম দলীয় কর্মী ইয়াছিনের জন্য। বর্তমানে স্থানীয় কাউন্সিলর বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। আমাকে লাভের ৩০ শতাংশ দেয়ার কথা রয়েছে। আমার ভাগের টাকা নিহত ইয়াছিনের পরিবারকে দিতে বলেছি। গোরস্থানের সামনের দোকান থেকে চাঁদা বা খাজনা আদায় করা উচিত না।
ওয়ার্ড কাউন্সিলর সায়েদ হোসেন নয়ন জানান, বাজারটি আমার ওয়ার্ডের ভেতর। মূল ইজারাদার জুয়েল ভাই। আমি তাকে কিছু টাকা দিয়েছি। এলাকার ২০ জন কর্মীর নামে বাজারটির সাব-ইজারা নিয়েছি। বাড়তি খাজনা নেয়া হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সামান্য কিছু রোজগার হয়। তাই দিয়ে পরিবারগুলোর সংসার চলছে।