পণ্য আমদানি কমেছে এক লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন
নিজস্ব প্রতিবেদক
বেনাপোল কাস্টমে গেল ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৮০ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। সেখানে আদায় হয়েছে ৫ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। এসময় ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে আমাদনি কম হয়েছে এক লাখ ৪৩ হাজার ৯২১ মেট্রিক টন পণ্য। বেনাপোল কাস্টম সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কাস্টম ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে খাদ্যপণ্য ছাড়া অন্য পণ্য আমদানিতে ব্যাংক এলসি খুলছে না। এতে ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী আমদানি করতে পারেনি। আবার সম্প্রতি বেনাপোল কাস্টমে ঘুষ গ্রহণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এবং একজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার নামে দুদক মামলা করার বিষয়টি নিয়ে সমলোচনা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে কাস্টমের ঘুষ বাণিজ্যের কারণে গত ১০ বছর ধরে বেনাপোল কাস্টম লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে পারেনি। সিএন্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে তারা ফাইল প্রতি ঘুষ নিয়ে থাকে।
বেনাপোল কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, গেল ২০২২-২৩ অর্থবছরের পণ্য আমদানি হয়েছে ২০ লাখ ৩৫ হাজার ৪৯৯ মেট্রিক টন। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের পণ্য আমদানি হয়েছিল ২১ লাখ ৭৯ হাজার ৪২০ মেট্রিক টন।
আমদানি কম হয়েছে এক লাখ ৪৩ হাজার ৯২১ মেট্রিক টন। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে গেছে। গেল বছরে (২০২২-২৩) বেনাপোল কাস্টমস হাউজে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা, সেখানে আদায় করা হয়েছে ৫ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ২৪৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, সেখানে আদায় হয়েছিল ৪ হাজার ১৪৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। ওই বছর ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৯৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
২০১৯-২১ অর্থবছরে পণ্য আমদানি করা হয়েছিল ২০ লাখ ৩৮ হাজার ৬৪ মেট্রিক টণ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য আমদানি করা হয় ২০ লাখ ১১ হাজার ৬ মেট্রিক টন পণ্য।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামসুর রহমান বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়াতে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের বেনাপোল দিয়ে বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি। তবে বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে সরকার এলসিতে শতভাগ মার্জিন শর্ত দিয়েছে। আবার ব্যাংকগুলো ডলার সংকট দেখিয়ে এলসি খুলছে না। যেকারণে গেল বছরে আমদানি কমে গেছে। আর আমদানি কমলে রাজস্বও কম আসবে এটাই স্বাভাবিক।
যশোরের আমদানিকারক এজাজ উদ্দিন টিপু বলেন, আমরা মোটরসাইকেল পার্টস আমদানি করে তা সারা দেশে বিক্রি করে থাকি। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে যশোরের কোন ব্যাংক এলসি খুলছে না। যেকারণে আমরা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করতে পারিনি। পণ্য আনতে না পারার কারণে ব্যবসায়ীকভাবে লোকসান হচ্ছে। সামনে কি পরিস্থিতি হবে কে জানে।
ভারত-বাংলাদেশ ল্যান্ডপোর্ট ইমপোর্ট এক্সপোর্ট কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান জানান, এলসি করতে না পারায় ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি করতে পারছে না। যেকারণে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে গেছে। ডলার সংকট কেটে গেলে আমদানির হার বেড়ে যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আমদানিকারক জানান, কাস্টমের নানা হয়রানি আর বন্দর ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের কারণে অনেক ব্যবসায়ী বেনাপোল ছেড়ে অন্য বন্দরে চলে গেছে। কাস্টমকে টাকা দিতে হয় বাধ্যতামূলক। তা না হলে বিভিন্ন অজুহাতে আমদানিকারকদের হয়রানির শিকার হতে হয়।
ঢাকা বিমানবন্দরে ২৩ লাখ টাকাসহ আটক বেনাপোল বন্দরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা খন্দকার মুকুল হোসেনের নামে গত ১২ ফেরুয়ারি মামলা করে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালক আল আমিন। সম্প্রতি এক রাজস্ব কর্মকর্তার ঘুষ নেয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর সমালোচনায় কাস্টম। ভিডিওতে দেখা যায়, বেনাপোল কাস্টমস হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) বনলতা রায় নিজ দপ্তরে বসে আছেন। সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে একদল লোক। পর্যায়ক্রমে ওই কর্মকর্তা তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা নিয়ে ড্রয়ারে গুনে রাখছেন। এরপর ক্যালকুলেটরে হিসেব মিলিয়ে নিয়ে সামনে থাকা ফাইলে দিচ্ছেন বিশেষ চিহ্ন। লেনদেন নিয়ে সন্তুষ্ট না হওয়ায় এদের একজনের ফাইলটিতে বিশেষ চিহ্ন না দিয়ে সরিয়ে রাখেন তিনি।
ব্যবসায়ীরা জানান, বনলতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো সিএন্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধি। ‘স্পিড মানি’ নামে সাপ্তাহিক ঘুষের টাকা দিচ্ছেন তারা। তারা বলেন, এসব কারণে এখন অনেকেই বন্দরবিমুখ হচ্ছেন। প্রতিটা টেবিলে ঠিকমত যদি তাদের মাসোয়ারা না দেয়া হয় তখনই তারা ফাইল নিয়ে টালবাহানা করে নানা রকম দুর্নীতি করে। ফলে আমরা ব্যবসায়ীরাতো আছি, সরকারও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়ে বেমালুম অস্বীকার করেন অভিযুক্ত বনলতা রায়। ফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কোন ভিডিওর কথা বলছেন জানি না। তবে কোনো কিছু কিনতে দেওয়ার জন্যে হয়তো কাউকে টাকা দিচ্ছিলাম।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, সরকার এলসি করতে শতভাগ মার্জিন দেবার নিয়ম করেছে। গত কয়েক মাস ধরে ব্যাংকগুলো এলসি খুলছেনা। এতে আমদানির সাথে জড়িত হাজার হাজার ব্যবসায়ী অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত রয়েছেন। এখন আমদানিকারকরা চরম বেকায়দায় পড়েছে। একেতো বাণিজ্য ভালো নেই, তার উপর পণ্য আমদানি করতে না পারলে আমদানির সাথে জড়িতরা আর্থিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাবে।
বেনাপোল কাস্টমস হাউজের যুগ্ম কমিশনার সাফায়েত হোসেন জানান, ডলার সংকটে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে এলসি খুলতে পারছেনা। যেকারণে পণ্য আমদানি কমে গেছে। আর আমদানি কমলে আমাদের রাজস্ব আয়ও কমে যায়। তারপরও আমাদের রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ২৮ শতাংশ। ঈদের ছুটির কারণে জুন মাসের কয়েকদনি বন্ধ ছিল। যেকারণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা কম রাজম্ব আদায় হয়েছে। আমাদের এখানে কোন হয়রানি হয়না বলে তিনি দাবি করেছেন।