শাহারুল ইসলাম ফারদিন
যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরে একটি সক্রিয় চোরাচালান সিন্ডিকেটের সন্ধান মিলেছে। বন্দরের শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধ উপায়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে খোদ কাস্টমস কর্মকর্তা, স্থলবন্দরের কর্মকর্তা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের একটি অংশ সরাসরি জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ফলে দেশের বৃহত্তম এই স্থলবন্দরটি এখন আমদানি-রপ্তানির প্রবেশদ্বার নয় বরং একটি সুসংগঠিত চোরাচালান চক্রের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে এবং বন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বেনাপোল বন্দরে অবৈধভাবে পণ্য পাচার সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বন্দরের ওয়্যার হাউস সুপারিনটেনডেন্ট আশিকুর রহমান রনি, আসমাউল হোসেন, রজব আলী ও ট্রাফিক ইন্সপেক্টর জাবেদি বিল্লাহ এবং কাস্টমস হাউজ পিসি হেলালুজ্জামানসহ ১৫ জন। তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বন্দরের একাংশে নিয়মিত পণ্য পাচার হয়ে থাকে। এদের সহযোগী হিসেবে আনসারের একাধিক সদস্যকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা হলেন- সোহেল রানা, অসিত কুমার বিশ্বাস, ইয়েমিন কবির, আসাদুজ্জামান, ইউনুস, রাসেল শেখ, বাদশাহ, নাজমুল হক, কৃষ্ণ কুমার দাস ও আনন্দ কুমার দাস।
গত ২২ সেপ্টেম্বর বেনাপোলের ভবেরবেড় বাইপাস সড়ক থেকে একটি ট্রাক আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ট্রাকের মধ্যে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ভারত থেকে প্রায় আড়াই কোটি টাকার পণ্য (ভারতীয় শাড়ি, থ্রি-পিস, ওষুধ, মোটরসাইকেলের টায়ার এবং বিভিন্ন প্রকার কসমেটিকস) ছিল। গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে বিশেষ বাহিনীর হাতে আরও একটি ট্রাক ও ২৬ সেপ্টেম্বর গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে বেনাপোল কার্গো ভেহিকেল টার্মিনালে তিনটি ভারতীয় ট্রাক আটক হয়। এসব ঘটনায় নড়েচড়ে বসে বন্দর কর্তৃপক্ষ। পরে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তদন্তে দেখা যায়, ২২ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বন্দরের বিভিন্ন গেটে দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরা পণ্য চোরাচালানে সরাসরি সহযোগিতা করেছেন। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ১৬ অক্টোবর আনসার প্লাটুন কমান্ডার অসিত কুমার বিশ্বাস ও ইয়ামিন কবিরকে প্রত্যাহার এবং তাদের বায়োমেট্রিক হাজিরা স্থগিত করা হয়। পাশাপাশি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা আল আরাফাত সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা আল আমিন সিকদারকেও বরখাস্ত করা হয়।
তদন্ত এখানেই থেমে থাকেনি। গোয়েন্দা সংস্থার হাতে ধরা পড়েছে বন্দরের ভেতর গড়ে ওঠা একটি শক্তিশালী চোরাচালান সিন্ডিকেট। মূলহোতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন ওয়্যার হাউস সুপারিনটেনডেন্ট আশিকুর রহমান রনি, ট্রাফিক ইন্সপেক্টর জাবেদি বিল্লাহ, কাস্টমস হাউসের পিসি হেলালুজ্জামান ও কর্মকর্তা রজব আলীসহ মোট ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ পণ্যের চালান বন্দরে প্রবেশ করানো হতো। প্রশাসন জানিয়েছে, এদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান হবি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বেনাপোল বন্দরের একটি চক্র মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে ও নো এন্ট্রি (কাগজে-কলমে না দেখিয়ে) পণ্য আমদানি করে আসছে। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে আর সৎ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বেনাপোল স্থলবন্দর পরিচালক (উপ-সচিব) শামীম হোসেন বলেন, যাতে অভিযুক্ত কেউ আর বন্দরের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বন্দরের কাস্টমস কমিশনার খালেদ মো. আবু হোসেনের সাথে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। তবে কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে, ঘটনাটির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চলছে এবং প্রমাণ মিললে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে এসব ঘটনার পর বন্দরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ১৬ অক্টোবর থেকে শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) অস্থায়ীভাবে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম।

 
									 
					