রায়হান সিদ্দিক
ষাটের দশক থেকে একুশ শতকে বহু গুণী সংস্কৃতিমনা মানুষের জন্ম হয়েছে যশোরের মাটিতে। তারা কর্মের মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়েছেন পরিবর্তনের আলো। কেউ কণ্ঠে, কেউ যন্ত্রে, কেউ লেখনির মাধ্যমে কেউবা অভিনয়ের নিপুণতায় হাজারো মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটেছেন। সেই গুণীজনরা আজ দুনিয়াতে নেই। তবে বেঁচে আছে তাদের কর্ম-আদর্শ। এমন আলোর পথযাত্রীরা ঘুরেফিরে আসে নানা আলোচনায়। এমন ২০ গুণীদের স্মরণ করা হয়েছে এবারের লোকজ সংস্কৃতি উৎসব ও বৈশাখী মেলায়। যশোর শহরের টাউনহল ময়দানে দশদিন ব্যাপী মেলার মাঠের মাঝ বরাবর তিনপাশে নাম ও ছবি টাঙিয়ে স্মরণ করা হয়েছে তাদের। যোগ্য সম্মান দিয়ে ব্যানার লেখা হয়েছে। সম্বোধন করা হয়েছে ‘আলোর পথযাত্রী’ হিসেবে।
লোকজ সাংস্কৃতিক উৎসব ও বৈশাখী মেলার সদস্য সচিব ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোরের সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার আলম খান দুলু বলেন, সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে দিয়ে এই মানুষগুলো সমাজকে, মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করেছেন। মানুষকে সৃজনশীল ও নান্দনিক করার কাজই তারা করেছেন। এই কাজটিতো অবশ্যই আলো বিতরণ করা। জীবদ্দশায় মানুষকে আলোকিত করার কাজে নিয়োজিত থাকায় তারা আজ ‘আলোর পথযাত্রী’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, এই সামান্য প্রয়াসের মাধ্যমে আমরা তাদের সম্মান করার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি বর্তমান তরুণ সংস্কৃতিকর্মীরা আজ যে দাপটের সাথে কাজ করছেন বা শিল্প চর্চা করছেন তাদেরও জানা উচিৎ তারা কাদের উত্তরসূরী। সেই লক্ষ্যে আমাদের এমন উদ্যোগ।
‘আলোর পথযাত্রী’ এই তালিকায় রয়েছেন বাংলা গানের সুরের জগতের এক উজ্জল নক্ষত্র সুরকার ও সংগীতপরিচালক প্রণব ঘোষ। কয়েক হাজার জনপ্রিয় গানের সৃষ্টি হয়েছে যার সুর সংগীতে। প্রণব ঘোষের জনপ্রিয় গানগুলো আজও স্রোতা হৃদয় স্পর্শ করে আছে। ১৯৫০ সালে যশোর শহরের মাইকপট্টি সংলগ্ন বাগমারাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা প্রফুল্ল ঘোষ ছিলেন একজন আইনজীবী এবং মাতা রত্না প্রভা ঘোষ ছিলেন গৃহিণী। পরিবারে মোট ৪ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে প্রণব ছিলেন সবার ছোট।
মধুসূধন শাঁখারী : ৭০-৮০ এর দশকে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের রবীন্দ্র ও আধুনিক সঙ্গীতের রাজা বলা হয় মধুসূধন শাঁখারীকে। তিনি সুরধনী ও সুরবিতানের সংগীতশিক্ষক ছিলেন।
গোলক বিহারি বর্মন : দেশের শাস্ত্রীয় সংঙ্গীতে যার অবদান ভূলবার নয় তিনি যশোরের চাঁচড়া বর্মন পাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলক বিহারি বর্মন। তিনি ছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীত ও নজরুল সঙ্গীতের জাদুকর।
গৌর গোপাল হালদার: বাংলাদেশের রবীন্দ্র সঙ্গীতের একজন স্বনামধন্য শিক্ষক ও শিল্পী। সারা দেশে তার অসংখ্য শিষ্য তৈরি হয়েছে। সংস্কৃতিজনদের দাবি যশোরে যারা রবীন্দ্র সংঙ্গীত চর্চা করেন তাদের ভেতর এমন কেউ নেই যে তারা গৌর গোপাল হালদারের সান্নিধ্য পায়নি।
নিবাস মন্ডল : স্বরলিপি সংঙ্গীত নিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা এবং একজন স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী ছিলেন।
হায়দার আলী চৌধুরী সনু : জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত উদীচী জেলা সংসদের সাথে ছিলেন। নিপুণ অভিনয় শৈলীর মাধ্যমে তিনি চির অমর হয়ে আছেন যশোরের সাংস্কৃতিক কর্মীদের মাঝে।
ফরহাদ করিম আবু ইউসুফ মুরাদ: কৈশর বয়স থেকেই নাট্যমোদী হয়ে ওঠেন এই গুণীজন। উদীচী জেলা সংসদের নাট্যকর্মী ছিলেন।
সেলিম হোসেন: যশোরের অন্যতম একজন নৃত্যশিল্পী। বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের নাচের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ভৈরব যশোরের সভাপতি থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
আব্দুল হাসিব : যশোরের প্রগতিশীল সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ষাটের দশকে যত সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছে সেখানে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
ওস্তাদ মোশারফ হোসেন : দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের শাস্ত্রীয় সংঙ্গীতের সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন ওস্তাদ। যশোরের যারা প্রবীণ শিল্পী আছেন তারা প্রায় সকলেই তার ছাত্র।
ডা. কাজী রবিউল হক : ষাট দশক থেকে সকল প্রগতিশীল সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তার অবদান রয়েছে। তিনি উদীচী যশোর জেলা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা।
অ্যাডভোকেট কাজী আব্দুস শহীদ লাল : প্রগতিশীল সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তার অবদান রয়েছে। যশোরে বই মেলা, বৈশাখী মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রার ক্ষেত্রে তার অনন্য ভূমিকা রয়েছে। তিনি আমৃত্যু তির্যক যশোরের সভাপতি ছিলেন।
রুহুল হক খোকা : একজন সনামধন্য যন্ত্র শিল্পী। তিনি উদীচী যশোরের সভাপতি ছিলেন।
শাহ মোহাম্মদ মোর্শেদ : ষাটের দশক থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত যশোরের সংগীতজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তিনি একাধারে গায়ক, সংগীত শিক্ষক এবং উচ্চঙ্গ ও নজরুল সঙ্গীতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। পাশাপাশি তিনি যশোরের সুরবিতান সংগীত একাডেমীর কর্মকর্তা ছিলেন এবং দীর্ঘদিন জাতীয় রবীন্দ্র সংঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ যশোর জেলার সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইকরামুল হক চৌধুরী ফকো : যশোরের অন্যতম শিশু সংগঠক ছিলেন।
অজিত গোস্বামী: সুরবিতান সংগীত একাডেমীর কর্মকর্তা ছিলেন। দেশের অন্যতম একজন তবলা শিক্ষক। যশোরের প্রবীণ সকল তবলা শিল্পী তার ছাত্র।
আবু সালেহ তোতা : তিনি তবলা শিলী ছিলেন। দুর্দান্ত সংগঠক। সুরবিতান সংগীতএকাডেমীর দীর্ঘদিন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। জেলা শিল্পকলা একাডেমীর নির্বাচিত সহসভাপতি ছিলেন।
সুকুমার দাস : একাধারে সংগীত শিল্পী, লেখক, সুরকার, গীতিকার। তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোরের সভাপতি, উদীচী যশোরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন।
ডি এম শহিদুজ্জামান : একজন তবলা শিল্পী, সংগঠক ছিলেন। উদীচী যশোরের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্বে ছিলেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোরের সভাপতি, জাতীয় রবীন্দ্র সংঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ যশোর জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ফখরে আলম : একজন সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিক। স্কুলজীবন থেকেই তিনি কবিতা লিখছেন। দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব পত্র-পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হয়েছে। বাংলা একাডেমীর উত্তরাধিকার ও পশ্চিমবঙ্গের শিব নারায়ণ রায় সম্পাদিত জিজ্ঞাসা পত্রিকায় তার কবিতা স্থান পেয়েছে। ১৯৮০-৮১ সালে ফখরে আলম যশোর সরকারি এমএম কলেজের ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯১ সালে যশোর সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকার সময় দেশ বিদেশের খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিকদের নিয়ে একটি সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেন। এরপর ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি যশোর সাহিত্য পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।