ফিচার ডেস্ক
দেশ ভাগ হওয়ার পর কেটে গেছে সাত দশক। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সেই দেশ বিভাগের আগে এ ভূখণ্ডের শিল্প, সংস্কৃতি ছিল মূলত একই ধাঁচের। দুই দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূল ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে একই শিকড়ে ভর করে। কৃষির শক্ত ভিত্তি ছিল কিংবা আছে বলেই সদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে শিল্প-প্রযুক্তি।
ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের শিল্পারামাম হংতে পারে এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। দেশের শিল্প সংস্কৃতিকে ধারণ করে ১৯৯২ সালে গড়ে ওঠে বিশাল এক কারুশিল্প গ্রাম। সম্পূর্ণ সরকারিভাবে পরিচালিত শিল্পারামাম ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের কারুপণ্য বিপণন করছে এখানে।
ভিলেজ মিউজিয়াম এরই একটি অংশ। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি যে দেশের মূল ভিত্তি সেটা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে এখানে শিল্পারামামের জেনারেল ম্যানেজার আনজায়াহ ঘুরে দেখালেন পুরো কারুশিল্প গ্রাম। এখানে ৩৫০টি ও ৯০টি অস্থায়ী স্টল আছে। সরাসরি উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয় বলে এখানে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী নেই। বড়রা ৬০ রুপি ও ছোটরা ২০ রুপি দিয়ে ঢুকে কেনাকাটাসহ করতে পারেন নানান অ্যাক্টিভিটিস।

যে প্রথাগত ধারণা সেটা থেকে ভিলেজ মিউজিয়াম একটু ব্যতিক্রম। নির্দিষ্ট কোনো ঘর নয়, এ গ্রাম জাদুঘর তৈরি মাটির স্পর্শ, গন্ধ মেখে। এখানে ঢুকে আপনি নিজেও সাজতে পারেন কৃষাণ-কৃষাণী কিংবা পটনৃত্যের চরিত্র। মাটির ‘জীবন্ত’ স্ট্রাকচার তৈরিই আছে, আপনার কাজ শুধু নিজের শরীর লুকিয়ে খোলা মুখের জায়গায় আপনার মুখ রেখে সেই চরিত্রে ডুব দেওয়া। এটাতে ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেলো দর্শনার্থীদের। বাদ গেল না ডেলিগেশন টিমের সদস্যরাও। সবাই যে যার মতো করে তুলে নিলো ছবি।
কখনো ভারতনাট্যমের ক্লাসিক্যাল নাচিয়ে, কখনো জোয়াল লাঙল কাঁধে নিয়ে মাঠে হাঁটা কৃষক, কখনো কোনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দম্পতি- বাদ গেলো না কিছুই। ঢুকেই এই ছোট ছোট চমকপ্রদ অ্যাক্টিভিটিসগুলো গ্রামীণ জীবনকে জানার, চেনার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে কয়েক গুণ।

গ্রামের মধ্যে আবার ছোট ছোট গ্রাম, বসতি কিংবা হাটবাজার রয়েছে। নরম আলোয় মাটির শরীরও যেন হয়ে উঠেছে জীবন্ত। গ্রাম-বাংলাই এক সময় ছিল এ উপমহাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি। নগরায়ণ, শিল্পায়ন, প্রযুক্তির দাপটে সেসব দিন হারাতে বসলেও চরকা, তাঁত, কুমোরের হাতে তৈরি নিটল মৃৎপাত্র কিংবা তালপাতা, কাপড়ে গাঁথা শিল্পচৈতন্য এখনো আবেদন রাখে।
গ্রাম তার চিরায়াত আবেদন অনেকটা হারিয়ে ফেলছে এ গুগল, ফেসবুক, টুইটারের যুগে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে সেটা জাদুঘরের বিষয়ই বটে। আশি-নব্বইয়ের দশকেও যে গ্রাম ছোটবেলায় আমরা দেখেছি সেটােত টেনে নিয়ে যাবে এ গ্রাম জাদুঘর। আর নতুন প্রজন্মের তো এই জাদুঘর দেখে বড় হওয়া ছাড়া উপায় নেই বলা চলে!
মা সন্ধ্যা দাওয়ায় বসে হারিকেন কিংবা কুপির আলোয় মেয়ের লম্বা চুলে তেল মেখে বেঁধে দিচ্ছেন, অন্যপাশে হয়তো বাড়ির ছোটরা বসেছে বই খুলে। বাবা তখন হয়তো অবসরে হুক্কা টানছেন, কিংবা সারাই করছেন জীবিকার অস্ত্র জাল, লাঙল কিংবা অন্য কিছু। তখন পরিবারের যে বন্ধন ছিল তা এখন অনেকটাই ঘরবন্দি।
বাজার ব্যবস্থাপনায় নারীরা সব সময়ই ছিল সক্রিয়। গ্রাম্য বাজারে নারীদের উপস্থিতিও ছিল কোনো কোনো যায়গায়। বাজারের সঙ্গে কামারশালা, কুমোর পাড়াও দেখা যেত এক সময়। এখন কমেছে এটাও। দুই দেশের গ্রামীণ সংস্কৃতি যে এক সুতোয় গাঁথা সেটা পরতে পরতে টের পাওয়া যাবে এ জাদুঘরে।
কুলায় করে ধান চাল ঝাড়া, পাথরের জাঁতাকলে ডাল কিংবা চাল গুঁড়া করা, ঢেকিতে চাল ছাঁটা সব চিত্রই মিলিয়ে দেবে দুই দেশকে, স্মরণ করাবে ৪৭ পূর্ববর্তী সময়কে।
আদিবাসী সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার গ্যালারিও মিলে যাবে আমাদের পার্বত্য এলাকার পাংখোয়া, চাকমা, মারমা, খুমি ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর সঙ্গে। লাউয়ের খোলে পানপাত্র, তুলা থেকে সুতা কাটা কিংবা জুমচাষ-সবই স্মৃতি জাগানিয়া।
বাদ পড়েনি ওঝা সংস্কৃতি, মহাজন প্রথাও। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মাঠ সংস্কৃতিও। ভারতের সবচেয়ে অগ্রসর রাজ্যগুলোর একটি এবং আইটি ও চিকিৎসার আইকন রাজ্য হয়ে ওঠা হায়দ্রাবাদের দুবাই, আমেরিকার মতো বিশাল সব ভবনের ফাঁক গলে গড়ে ওঠা এ গ্রাম জাদুঘর সত্যি নতুন প্রজন্মকে দেবে ভিন্ন স্বাদ। সুন্দর পরিচ্ছন্ন এ কারুশিল্প গ্রামে রয়েছে বিনোদনেরও ব্যবস্থা।

আমরা যখন ঢুকেছি তখন বিশাল অ্যাস্ফিথিয়েটারে তখন চলছে ক্ল্যাসিকাল নৃত্যে দেবী বন্দনা। কয়েকশ মানুষ বসে এটা উপভোগ করতে পারেন। বাচ্চারা যেন ঘুরতে গিয়ে বিরক্ত না হয় সেজন্য তাদের জন্য রয়েছে ছোট বিনোদন পার্ক।
পাশেই বিশাল এলাকাজুড়ে বৃন্দাবন! পানিতে আধডোবা রাধার সখীরা। ওপর থেকে নেমে এসেছে ঝরনাধারা। একটু দূরে কৃষ্ণের বাঁশির সুরে মোহিত রাঁধা।
কারুশিল্পের স্টলগুলিতে স্থান পেয়েছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পণ্য। কাঞ্জিভরম, গাদওয়াল কিংবা কলমকারির কাজের শাড়ি কিংবা থ্রিপিস, শার্ট। বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্যগুলো বেশ আভিজাত্যপূর্ণ। তালপাতায় আঁকা ক্ল্যাসিকাল শিল্পকর্ম বহন করে বিশেষত্ব।
তেলেঙ্গানা রাজ্য সরকারের তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগের যুগ্ম-পরিচালক এন ভেঙ্কটেরশ্বর রাও বলছিলেন, ‘আমরা যানজটের নগরে এমন এক আয়োজন করেছি, যেখানে এলে মানুষ গ্রামের প্রশান্তি পাবে। গ্রামকে অনুভব করবে। গ্রামীণ জীবনের স্মৃতিতে ফিরে যেতে পারবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম তাদের আগের প্রজন্মের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে পারবে। পুরো কারুশিল্প গ্রামটিই যান্ত্রিক নগরে এক চিলতে গ্রাম হয়ে উঠেছে।’
ভারত তাদের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে সব সময় অগ্রসর। আমরা এখনো কেন পিছিয়ে?