এইচ আর তুহিন
যশোরের ‘নরপশুদের’ হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না মানসিক ভারসাম্যহীন নারীরাও। তারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। তাদের ‘ছোঁবলে’ এসব নারীরা গর্ভধারণ, এমন কি সন্তান প্রসবও করছেন। কিন্তু বাবার পরিচয় মিলছে না। যশোরে ভবঘুরেদের আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় সহিংসতার ঘটনা ঘটার আগে তাদেরকে নিরাপদে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে যশোরে দিন দিন ভারসাম্যহীন নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সমাজ উন্নয়ন কর্মীরা।
এদিকে আজ ২৫ নভেম্বর শনিবার যশোরসহ আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ দিবস পালন করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে জনউদ্যোগের ব্যানারে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বিকেল সাড়ে তিনটায় শহরের দড়াটানায় মানববন্ধন, বিনামূল্যে রক্ত প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পরিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে নারী-পুরুষ ও শিশু। এরা ঘুরে বেড়ান পথে-ঘাটে। এদের মধ্যে ভারসাম্যহীন নারীরা শিকার হচ্ছেন পাশবিকতার। নরপশুরা এসব নারীকে ধর্ষণ করে। এতে অনেক নারী গর্ভধারণ এবং পিতৃ পরিচয়হীন সন্তান প্রসব করছেন।
জেলা প্রশাসন ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় যশোরের চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয় আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে। বেশ কয়দিন ধরে উপজেলার সিংহঝুলী ইউনিয়নের গরীবপুর গ্রামে অবস্থান করছিলেন তিনি। স্থানীয়দের মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয় তাকে। আর ২১ নভেম্বর রাত ৮ টার দিকে ওই ভারসাম্যহীন নারী একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু এই নবজাতকের বাবার পরিচয় মেলেনি।
একই ধরনের ঘটনা ঘটে গত ৩ সেপ্টেম্বর যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে। ভারসাম্যহীন আর এক নারী যমজ সন্তান জন্ম দেন। সন্তানের বাবার পরিচয় জানতে চাইলে একেক সময় এক এক ব্যক্তির নাম বলেছিলেন। পরে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসায় রাখা হয় প্রসূতি ও নবজাতকদের। ১৮ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার পর সরাকারি উদ্যোগে দেয়া হয় পুনর্বাসনে। মায়ের ঠিকানা হয় কশিমপুর সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে। আর দুই নবজাতকের ঠিকানা হয় খুলনার ছোট মণি নিবাসে।
এ রকম আরও ঘটনা ঘটছে। যা প্রকাশ পাচ্ছে না। অনেক সময় প্রথম দিকেই গর্ভপাত করানো হয়। যেসব ভবঘুরে নারীদের পরিবারের সাথে কিছুটা সংযোগ আছে, তাদেরকে স্বজনরা গর্ভপাত করান। আর কিছু ধর্ষণকারীরা নিজ উদ্যোগেই গর্ভপাত ঘটান।
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা রাইটস্ যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক জানান, নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটায়, তারা ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় থাকে। ভারসাম্যহীনদের সাধারণত অভিভাবক থাকে না। কিন্তু এদেরও অধিকার আছে। তাই রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব নিতে হবে ভবঘুরেদের। তিনি আরও বলেন, প্রথম থেকে ভারসাম্যহীনদের তালিকা করে পুনর্বাসন করলে এ ধরণের সহিংসতা থেকে মুক্তি মিলবে।
যশোর সরকারি এমএম কলেজের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান জানান, ভারসাম্যহীন নারীরা গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব করছে, এটি দুঃখজনক ঘটনা। পৃথিবীতে সন্তান আসাটি আনন্দের কথা। কিন্তু এ ধরনের নবজাতকের আগমন দুঃখবোধের। ভবঘুরেদের আশ্রয় ও ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্র ও সমাজের।
যশোর জেলা প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা মুনা আফরিন জানান, ভারসাম্যহীন নারীরা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সামাজিক অবক্ষয় ও কিছু ব্যক্তির মানসিক বিকারগ্রস্ততার কারণে ভবঘুরে নারীরা গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব করছে। তিনি আরো জানান, যশোরে ভবঘুরেদের আশ্রয় কেন্দ্র নেই। প্রথমেই এদের চিহ্নিত করে আশ্রয় কেন্দ্রে রাখতে পারলে পাশবিক এসব ঘটনা রোধ করা সম্ভব। নানা সংকটের মধ্যেও জেলা প্রশাসন, সমাজ কল্যাণ পরিষদ ও প্রতিবন্ধী দপ্তর ভবঘুরে ও প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বলে মুনা আফরিন জানান।