প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে প্রতারণা করা হচ্ছে
কল্যাণ রিপোর্ট
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহলের যোগসাজসে ভবদহবাসীকে ডুবিয়ে মারার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ। রোববার কমিটির যশোরস্থ অস্থায়ী কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ এই অভিযোগ করেন।
নেতৃবৃন্দ বলেন, দীর্ঘদিনের আন্দোলনে আমরা দাবি করে আসছিলাম আমডাঙ্গা খাল প্রসস্থ করে খনন, বিল কপালিয়ায় টিআরএম এবং পর্যায়ক্রমে বিলে বিলে টিআরএম চালু করে নদীর নাব্যতা রক্ষা ও জলাবদ্ধতার অবসানসহ উজানে পদ্মা-মাথাভাঙ্গা-ভৈরবের নদী সংযোগের সাথে মুক্তেশ্বরী নদীকে যুক্ত করে প্রবাহমান করা। দাবিটি বাস্তবসম্মত হলেও ২০১৩ সাল থেকে অদ্যাবধি প্রতিশ্রুতি ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মাধ্যমে জনগণের সাথে অব্যাহত প্রতারণা করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ জানান, ভবদহ সমস্যা সমাধানে পরীক্ষিত পদ্ধতি টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট-জোয়ারাধার) প্রকল্পকে বাদ দিয়ে পাম্মের মাধ্যমে সেচ প্রকল্প চালুর ষড়যন্ত্র করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে এই অঞ্চলের সঙ্কট আরও ভয়াবহ হবে। নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে সেচ প্রকল্প বাতিল ও টিআরএম চালুসহ ছয়দফা দাবি তুলে ধরেছেন।
দাবিগুলো হলো, প্রস্তাবিত প্রায় ৫০ কোটি টাকার সেচ প্রকল্প বাতিল করতে হবে, ভবদহ স্লুইচ গেটের ভাটিতে পাইলট চ্যানেল করার জন্য ৫-৬টি স্কেভেটর লাগাতে হবে এবং ২১, ৯ ও ৮ ভেন্টের গেটসমূহ ওঠানামার ব্যবস্থা করতে হবে, ক্রাস প্রোগ্রামে মাঘী পূর্ণিমার আগেই বিল কপালিয়া টিআরএম চালু করতে হবে, জনপদের ফসল, মাছসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং কৃষি ঋণ মওকুফ করতে হবে, আমডাঙ্গা খাল সংস্কার কাজে প্রি-ওয়ার্ক ও পোস্ট ওয়ার্ক জনসমক্ষে টাঙিয়ে দিতে হবে। কাজের স্বচ্ছতা নিরূপণে আন্দোলনকারী সংগঠন ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে তদারকি কমিটি গঠন করতে হবে এবং সরকারকে মিথ্যা তথ্য প্রদান, নদী হত্যা, জনপদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা, ফসল, বসতবাড়ি ও যানমালের ক্ষয়ক্ষতির সাথে জড়িত পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিত বাওয়ালী। উপস্থিত ছিলেন, ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ, অনিল বিশ্বাস, নাজিম উদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা গাজী আব্দুল হামিদ, জিল্লুর রহমান ভিটু, চৈতন্য কুমার পাল, শিবপদ বিশ্বাস, কার্তিক বকসী, ইলিয়াস হোসেন রাজু আহম্মেদ, উত্তম কুমার গাইন, চৈতন্য কবিরাজ, ইন্তাজ আলী, পলাশ মোল্যা, সবুজ কবিরাজ, গৌর চন্দ্র রায় প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, লুটেরা ও দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহলের যোগসাজসে ভবদহবাসীকে ডুবিয়ে মারার একের পর এক ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। ভবদহবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি, আমডাঙ্গা খাল প্রসস্থ করে খনন, বিল কপালিয়ায় টিআরএম এবং পর্যায়ক্রমে বিলে বিলে টিআরএম চালু করে নদীর নাব্যতা রক্ষা ও জলাবদ্ধতার অবসান এবং উজানে পদ্ম, মাথাভাঙ্গা ও ভৈরবের নদী সংযোগের সাথে মুক্তেশ্বরী নদীকে যুক্ত করে প্রবাহমান করা। যা বাস্তবত: সম্ভব হলেও ২০১৩ সাল থেকে অদ্যাবধি প্রতিশ্রুতি ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মাধ্যমে জনগণের সাথে অব্যাহত প্রতারণা করা হচ্ছে।
আন্দোলনের চাপে সম্প্রতি একনেকে আমডাঙ্গা খাল সংস্কারের বরাদ্দ হয়েছে। যা একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সে কাজ দ্রুত ও লুটপাট বর্জিত স্বচ্ছভাবে হবে কিনা তা নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে।
অপরদিকে টিআরএম প্রকল্প গ্রহণ না করায় ভবদহ স্লুইচ গেট থেকে প্রায় ৫০-৬০ কিলোমিটার নদী মেরে ফেলা হয়েছে। এক্ষেত্রে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সরকারের নদী বাঁচানোর গৃহিত নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং জনগণকে স্থায়ী জলাবদ্ধতার হাতে জিম্মি করে অর্থ লোপাটের স্থায়ী পরিকল্পনা ফেঁদেছে। সে পরিকল্পনার অংশ হিসাবে সহজ ও পরীক্ষিত সমাধান টিআরএম না করার জন্য জেদ ধরেছে।
নেতৃবৃন্দ দাবি করেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সরকারকে মিথ্যা তথ্য প্রদান করছেন এবং জনমতকে উপেক্ষা করে পাম্পের মাধ্যমে সেচ দিয়ে জলাবদ্ধতা মুক্ত করার অবিবেচনাপ্রসূত প্রকল্প দিয়ে অর্থ অপচয় করছেন। তাছাড়া ‘এবার পাম্প সেচের মাধ্যমে এলাকায় ব্যাপক ফসল উৎপাদন হয়েছে এবং জলাবদ্ধ হয়নি, মানুষের বাড়িঘর-রাস্তা এবং কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠেনি’ বলে মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছে।
নেতৃবৃন্দ উল্লেখ করেন, গত ১৫ নভেম্বর খুলনার চিফ ইঞ্জিনিয়ারের কার্যালয়ে ৫শতাধিক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সমবেত হয়ে পুনর্বার জানিয়েছিল- পাম্প নয়, ভাসমান স্কেভেটর দিয়ে পাইলট চ্যানেল করা হোক এবং ২১ ভেন্টের স্লুইস গেটগুলো তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক। পাম্প করে অর্থ অপচয় করার প্রয়োজন হবে না। চিফ ইঞ্জিনিয়ারও সে প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিলেন।
নেতৃবৃন্দ ক্ষোভের সঙ্গে জানান, পাউবো পাম্প প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জনমত উপেক্ষা করে প্রায় ৫০ কোটি টাকার সেচ প্রকল্পের বরাদ্দ চেয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। যে প্রস্তাব এখন পরিকল্পনা কমিশনে বিবেচনাধীন রয়েছে। ফলে অনভিপ্রেত যে পরিস্থিতির উদ্ভব হতে যাচ্ছে তার সমস্ত দায় তাদেরকেই নিতে হবে। এই গণবিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্রের দায় সরকারের উপরই বর্তাচ্ছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিগ্রস্ত চক্রের চক্রান্তে পুনর্বার ২০১৭ সালে জাতীয় কর্মশালায় গৃহিত টিআরএম প্রকল্প বানচালের ফলে এই জনপদের জনগণের বারবার হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল, বসতবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। জীবনযাত্রা হয়েছে বিপর্যস্ত। ২০২১ সালেই পানিতে ডুবে মারা গেছেন এক শিশুসহ ৪ জন। এদিকে, নদী মেরে ফেলার ফলে কেশবপুরের ২৭ বিলও জলাবদ্ধ হয়ে গেছে। নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবি জানান। অন্যথায় লাগাতার অবস্থানসহ বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণার হুশিয়ারি দেন।
যশোর-খুলনার দুঃখ হিসেবে খ্যাত ভবদহের স্থায়ী জলাবদ্ধতায় ভুক্তভোগীদের দাবি জলাবদ্ধতা নিরসনে বিএডিসি ও পাউবো যৌথ উদ্যোগে সেচ কার্যক্রমের নামে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা ব্যয় রা হলেও ভবদহ স্লুইচ গেট দিয়ে সেচ পাম্পে পানি নিস্কাশন কার্যক্রম সুফল বয়ে আনতে পারেনি। বরং বিলে পানি না থাকায় গেল বছরের তুলনায় এবার বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ আরো কমে গেছে। এখনও অন্তত ২০ গ্রামের লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। ফলে ব্যয় বহুল এ সেচ প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারওপর স্লুইচ গেটের তল দিয়ে লিকেজ (পানি টেকা নদীতে ফিরে আসা) হওয়ায় শুধুই পাম্পে পানি নিস্কাশন হ”েছ কিš‘ কাজের কাজ কিছুই হ”েছ না। বিষয়টি বিএডিসি কর্মকর্তারা একাধিকবার পাউবোর কর্মকর্তাদের অবহিত করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সম্প্রতি কৃষি সচিব, বিএডিসির চেয়ারম্যান, খুলনা বিভাগীয় প্রধান (সেচ প্রকল্প)সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভবদহ এলাকায় পরিদর্শন করেন এবং লিকেজের বিষয়টি ধরা পড়ে। এ নিয়ে যশোর সার্কিট হাউজে কৃষিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক সভায় পাউবোকে লিকেজের বিষয়টি দ্রুত সমাধানের নির্দেশও দেওয়া হয়।
পাউবো যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম বলেন, ভবদহ তৎসংলগ্ন বিলে ফসল ফলাতে ও পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ কষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগে চলতি বছরের শুরুতেই ভবদহ স্লুইচ গেট দিয়ে সেচ পাম্পে পানি নিস্কাশন কার্যক্রম শুরু হয়। তারপর শুনেছি স্লুইচ গেটের তল দিয়ে সামান্য লিকেজ (পানি টেকা নদীতে ফিরে আসা) হচ্ছে কিন্তু তা বন্ধে নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিএডিসির খুলনা বিভাগীয় প্রধান (সেচ বিভাগ) আব্দুল্লাহ আল রশিদ জানান, এ অঞ্চলের বিলে ফসল ফলাতে ও মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পাউবোকে বিএডিসি ৩০ এইচপি (হর্সপাওয়ার) পাওয়ারের ২০টি পাম্প সরবরাহ করে। যা রক্ষণাবেক্ষণে বিএডিসির ৮ জন লেবারসহ একজন উপ-প্রকৌশলী সেখানে সার্বক্ষণিক দেখভাল করে থাকেন। কিন্তু লিকেজ দৃষ্টিগোচর হওয়ায় তা পাউবোকে অবহিত করা হলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি যপবিস-২-এর ডিজিএম (কারিগরি) আবু হেনা শফিক কামাল জানান, পাউবোর আবেদনের প্রেক্ষিতে সেচ পাম্প কার্যক্রম চালাতে গত ৪ জানুয়ারি ২০টি সংযোগ দেওয়া হয়। পাম্প চালাতে ৭০০ কেভিএ ট্রান্সফরমার বসাতে কন্সট্রাকশন ব্যয় হয় ৭ লাখ ৬০ হাজার এবং ট্রান্সফরমারের জন্য ব্যয় হয় প্রায় ২৫ লাখ টাকা। পুরো ব্যয় সমিতির পক্ষে করা হয়েছে। এ ছাড়া পাউবো প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে প্রায় ১৪ লাখ টাকা।
ভুক্তভোগী কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিএডিসির ৮ লেবারের জন্য প্রতিদিন ৪ হাজার টাকা ব্যয়সহ সেচ পাম্পে নির্বিঘেœ পানি সরবরাহে পউবোর আওতায় প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে টেকা নদী খনন করা হচ্ছে। কিন্ত এত কর্মযজ্ঞের পরও এ সেচ কার্যক্রম এ অঞ্চলের মানুষের উপকারে আসেনি। গেল বারের চেয়ে এবার বোরো মৌসুমে ভবদহ সংলগ্ন বিলগুলোতে ধানের আবাদ কমেছে।
মণিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবুল হাসান জানান, গত বোরো মৌসুমে উপজেলায় প্রায় ২৯ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়। ভবদহ সংলগ্ন ৫টি বিলের প্রায় ৪০০ হেক্টর জমিতে এবার বোরো ধানের আবাদ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেছে।
ভবদহ পানি নিস্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতা আব্দুল হামিদ বলেন, সম্প্রতি ভবদহ সংলগ্ন ৩০ গ্রামের মানুষের সাথে এক সভায় উপস্থিত একজনও বলেনি সেচ পাম্পে পানি নিস্কাশনে উপকৃত হয়েছেন।
বাজেকুলটিয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক পরমানন্দ রায় বলেন, বাজেকুলটিয়া, হাটগাছা, ডহর মশিয়াহাটি, সুন্দলী, আন্দা, ডুমুরতলা, বেদভিটাসহ কমপক্ষে ২০ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। সরখোলা ডুমুরতলা প্রধান সড়কে এখনও খেয়া পারাপার অব্যাহত রয়েছে। অথচ শোনা যাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সরকারকে মিথ্যা তথ্য পাঠিয়ে বলা হয়েছে ‘এবার পাম্প সেচের মাধ্যমে এলাকায় ব্যাপক ফসল উৎপাদন হয়েছে এবং জলাবদ্ধ হয়নি, মানুষের বাড়িঘর-রাস্তা এবং কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠেনি’ বলে মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছে।