ভারত থেকে আসা শীর্ষ ১০টি পণ্যের মধ্যে পাঁচটি তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল সম্পর্কিত—তুলা, তুলার সুতা ও বিভিন্ন কেমিক্যাল। এ ছাড়া চাল, ডাল, সয়াবিন, মোটরসাইকেল ও পেঁয়াজ রয়েছে। প্রায় সাড়ে ৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানির বড় অংশই দখল করে আছে এই ১০ পণ্য।
কল্যাণ ডেস্ক
ভারতের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইলের কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বেড়েছে। এতে বেড়েছে আমদানির সময়ও। এর ফলে প্রতিবেশী দেশটি থেকে আমদানি কিছুটা নিম্নমুখী হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারত থেকে ৯৪১ কোটি ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার ৬১৮ ডলারের পণ্য আমদানি হয়। পরের অর্থবছর ২০২৩-২৪-এ ভারত থেকে আমদানি হয় ৯৪১ কোটি ৭৩ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮৪ ডলারের পণ্য। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের বছরে ভারত থেকে আমদানি হয় ৯৩৬ কোটি ৯৮ লাখ ১ হাজার ২০২ ডলারের পণ্য। আর চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট দুই মাসে আমদানির পরিমাণ ছিল ২০৯ কোটি ৬৬ লাখ ৪০ হাজার ৬২৭ ডলার।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে আওয়ামী সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে সড়ক অবরোধ ও ইন্টারনেট বন্ধের কারণে আমদানি-রপ্তানিতে বিঘ্ন ঘটে। ফলে আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কম আমদানি হয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসেও আমদানির ক্রমাবনতির চিত্র স্পষ্ট হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশটি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে স্থলবন্দর ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। ফলে বেশকিছু পণ্য সাগরপথে আমদানি করতে হচ্ছে, যা খরচ ও সময় উভয়ই বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় বিকল্প হিসেবে কিছু পণ্য তৃতীয় দেশ থেকে আমদানির প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। উৎপাদন ব্যাহত না হওয়ার স্বার্থে গার্মেন্ট ও টেক্সটাইলের কাঁচামাল আমদানি আগের মতোই বজায় থাকলেও কিছু পণ্যের আমদানি কমেছে।
তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্পের কাঁচামাল এবং খাদ্যপণ্য আগের মতোই আমদানি হচ্ছে। ভারত থেকে আসা শীর্ষ ১০টি পণ্যের মধ্যে পাঁচটি তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল সম্পর্কিত—তুলা, তুলার সুতা ও বিভিন্ন কেমিক্যাল। এ ছাড়া চাল, ডাল, সয়াবিন, মোটরসাইকেল ও পেঁয়াজ রয়েছে। প্রায় সাড়ে ৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানির বড় অংশই দখল করে আছে এই ১০ পণ্য।
তবে ৫ আগস্টের পর ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যে বৈচিত্র্য এসেছে। বস্ত্রশিল্প সম্পর্কিত পণ্য ছাড়া খাদ্যপণ্যের আমদানি কমেছে। আগের বছরগুলোতে চিনি, সয়াবিন, ভুট্টা ও পেঁয়াজ তালিকার শীর্ষে ছিল। ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সব পণ্যের আমদানি কমে যায়। অন্যদিকে, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে বড় অঙ্কের অর্থ যুক্ত হওয়া এবং মোটরসাইকেল আমদানি বৃদ্ধির কারণে ভারত থেকে আমদানি বেড়েছে।
তথ্য বলছে, আমদানিতে বড় পরিবর্তন না হলেও আমদানি বাণিজ্যের দিক পরিবর্তনের পথে রয়েছে।
ভারতে থেকে আমদানি বন্ধ সম্ভব নয় যে কারণে
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, অর্থনীতি সচল রাখতে ইচ্ছা করলেই ভারত থেকে পুরোপুরি আমদানি বন্ধ করা সম্ভব নয়। এর পেছনে দুটি বড় কারণ রয়েছে। প্রথমত, পোশাক ও টেক্সটাইলের কাঁচামাল ভারত থেকে কম দামে আমদানি করা যায়, কিন্তু তৃতীয় দেশ থেকে আমদানি করলে তা বেশি দামে হয়। দ্বিতীয়ত, ভারত থেকে চাল, গম, পেঁয়াজ, সয়াবিনের মতো খাদ্যপণ্যও আমদানি হয়ে থাকে।
দেশটির অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি অব্যাহত থাকলে ব্যবসায়ীরা বিকল্প তৃতীয় দেশ থেকে আমদানির প্রবণতা বাড়াবেন—যা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এতে যেমন বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি ভারতও ক্ষতির মুখে পড়ছে। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, এটি যেন ‘নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করা’র মতো অবস্থা।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক আব্দুর রহিম ফিরোজ বলেন, “ভারত সুবিধা দেখে কাজ করে। আমাদের ট্রান্সশিপমেন্টের কারণে তারা ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। এর ফলে আমাদের চ্যালেঞ্জ ও খরচ দুটোই বেড়েছে। বাড়তি সময় লাগলেও আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এতে ব্যবস্থাপনায় কিছুটা কষ্ট হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “আগে ভারত থেকে সাত দিনের মধ্যে মালামাল আসত, এখন ১৭-১৮ দিন সময় লাগছে। এখন তারা স্থলবন্দরের পরিবর্তে জাহাজে করে মাল পাঠাচ্ছে, এতে সময় বেশি লাগছে।”
আব্দুর রহিম ফিরোজ অভিযোগ করে বলেন, “৫ আগস্টের আগে-পরের বিষয়টি রাজনৈতিক। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে এমন আচরণ কাম্য নয়। শেখ হাসিনা ভারতে থাকাকালীন সময়ে তারা আমাদের ল্যান্ডপোর্ট বন্ধ করে দিয়েছে নানা অজুহাতে। এটা রাজনৈতিক, সবাই জানে।”
তিনি আরও বলেন, “ভারত বাংলাদেশে ৮-৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এখন তারা মনে করছে, এর মধ্যে এক-দুই বিলিয়ন ডলার কমলেও সমস্যা নেই, বরং এতে বাংলাদেশকে চাপে ফেলা যাবে। কিন্তু এতে তাদেরও ক্ষতি হচ্ছে, নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো অবস্থা।”
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “কোনো দেশ থেকে কাঁচামাল বা পণ্য আমদানি নির্ভর করে ব্যবসার সুবিধার ওপর। কোনো পণ্যের দাম কিছুটা বেশি হলেও যদি শিপিং খরচ কম হয় এবং কম সময়ে পণ্য আনা যায়, তাহলে ব্যবসায়ীরা সেটাই বেছে নেন। ৫ আগস্ট দেশের ভেতরের পরিবর্তনের পরও বাণিজ্যের প্রবণতা সেই বাস্তবতার প্রতিফলন।”
বিএনপির আন্তর্জাতিক উপ-কমিটির সদস্য ও উদ্যোক্তা ইসরাফিল খসরু বলেন, “আমাদের বাণিজ্যনীতি হতে হবে বহুপাক্ষিকতার ভিত্তিতে। কোনো নির্দিষ্ট দেশের জন্য আলাদা করে নীতি থাকা উচিত নয়। সরবরাহ চেইনের প্রয়োজন অনুযায়ী, যেখানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্বার্থ ও সুবিধা রয়েছে, সেখানে বাণিজ্যে অংশ নিতে হবে। এটি হতে হবে পারস্পরিকতা, ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে।”
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “আমদানি কমার কারণ হলো কার্যাদেশ কমে যাওয়া। এজন্য ভারত থেকে তুলা আমদানিও কমেছে।”
তিনি বলেন, “আমরা নিটওয়্যারের জন্য যে সুতা আমদানি করি, তাতে বড় পরিবর্তন হয়নি। কারণ, ভারত থেকে কেজিপ্রতি দুই থেকে তিন সেন্ট কমে আমদানি করা যায়। পাকিস্তান বা ইন্দোনেশিয়া থেকে আনলে কেজিপ্রতি ২-৩ সেন্ট বেশি দিতে হয়।”
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “দুটি কারণে আমরা ভারত থেকে তুলা আমদানি করি। প্রথমত, কম দামে পাওয়া যায়; দ্বিতীয়ত, কম সময়ে দেশে আনা সম্ভব হয়। ভারত থেকে যে সুতা ২ ডলার ৫৫ সেন্টে আমদানি করা যায়, ইন্দোনেশিয়া থেকে আনলে ২ ডলার ৬৫ সেন্ট, আর ভিয়েতনাম থেকে আনলে ২ ডলার ৬০ সেন্ট খরচ হয়।”
তিনি আরও বলেন, “সুতা আমদানির ক্ষেত্রে আগে প্রণোদনা ছিল, যা ২০২৪ সালে তুলে দেওয়া হয়েছে। তখনই বলেছিলাম, এতে সুতার বাজার অন্য দেশের হাতে চলে যেতে পারে, আসলে তাই হয়েছে।”
এনবিআরের তথ্য তুলে ধরে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “২০২৩ সালে স্থলবন্দর দিয়ে ৩৬ হাজার মেট্রিক টন সুতা এসেছে, আর ২০২৪ সালে তা বেড়ে ৯৬ হাজার মেট্রিক টনে পৌঁছেছে। কারণ, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সুতার ওপর প্রণোদনা বন্ধ করা হয়। এর পরপরই ভারত থেকে সুতা আমদানি বেড়ে যায়। এখন আবার কমছে, কারণ তৈরি পোশাকের কার্যাদেশ কমে গেছে। এই ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকতে পারে।”
