নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোরের দড়াটানা থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত ৪২টি ল্যাম্পপোস্ট রয়েছে। কিন্তু এর একটিতেও বাতি জ্বলে না। অন্যদিকে দড়াটানা মোড় থেকে সিভিল কোর্ট মোড় পর্যন্ত রয়েছে ২৪টি এবং দড়াটানা থেকে গরীবশাহ মাজার পর্যন্ত ৮টি পোস্ট। সেগুলোও অচল হয়ে পড়ে আছে।
কোনোটির লাইট স্ট্যান্ড ঝুলে রয়েছে, কোনোটির লাইট নষ্ট, আবার কোনোটির লাইট হাওয়া। এর বাইরেও দড়াটানা থেকে কাঠেরপুল পর্যন্ত ৩৩টি ল্যাম্পপোস্টের মধ্যে মাত্র হাতে গোনা ৩টি লাইট সচল। মসজিদ গলি, ঝালাইপট্টি হয়ে গোহাটা রোডের ল্যাম্পপোস্টগুলোর হালও একই রকম। একই অবস্থা জেল রোড, নওয়াপাড়া রোড ও সেন্ট্রাল রোডেরও।
দড়াটানা ও টাউন হল মাঠের দুটি সার্চ লাইটে কিছু এলাকা আলোকিত থাকলেও বাকি সব এলাকায় থাকে ভূতুড়ে অন্ধকার। শহরের পাড়া-মহল্লার অবস্থা আরও করুন!
একদিকে বাড়ছে চুরি-ছিনতাই, অন্যদিকে ভূতুড়ে অন্ধকারে পায়ে হেঁটে চলাচল দূরের কথা, যানবাহনে চলাচলও দুষ্কর হয়ে পড়েছে শহরবাসীর জন্য। অন্যদিকে, লাইট নেই অজুহাত দিয়ে কর্মচারীরা বসে আছেন। লুজ কালেকশনও ঠিক করছেন না তারা। দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বিষয়টি নিয়ে পৌর কর্মচারীদের চরম অবহেলা আছে বলে দাবি করছেন শহরবাসী।
সোমবার রাত সাড়ে ১১টায় সরেজমিনে দড়াটানা থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত গিয়ে দেখা যায়, সবগুলো লাইটই বন্ধ। বিশেষ করে ঝালাইপট্টির সড়কটি দেখে বোঝা যাচ্ছিল না, সেটা সড়ক, না বাঁশঝাড়। দেখা যায় চৌরাস্তার মোড়ের একটি ল্যাম্পপোস্টে একটি লাইট জ্বলছে। চৌরাস্তা থেকে তাকিয়ে দেখা যায়, রেলরোডের অধিকাংশ লাইটও বন্ধ রয়েছে। চৌরাস্তা থেকে কাপুড়িয়া পট্টি হয়ে কালীবাড়ি মোড় পর্যন্ত আটটি ল্যাম্পপোস্ট থাকলেও সবকটিই বিকল। কাঠেরপুল এলাকা গভীর অন্ধকার। মাংস ব্যবসায়ীদের কয়েকজন ব্যক্তিগত উদ্যোগে লাইট জ্বালালেও কাঠেরপুলের এ মাথা থেকে জেল রোডের মাথা পর্যন্ত সবকটি লাইট বিকল দেখা যায়। কাঠেরপুল থেকে দড়াটানা মোড় পর্যন্ত ৩৩টি ল্যাম্পপোস্ট তার মধ্যে শোরুমের সামনে একটি, জব্বার অ্যান্ড সন্সের পাশের একটি ও দড়াটানা মোড়সংলগ্ন একটি লাইট জ্বলছে। বাকি ৩০টি লাইটই নষ্ট। এছাড়া মসজিদ গলিতে ৫টি ল্যাম্পপোস্ট চোখে পড়লেও সবগুলোর লাইটই বন্ধ পাওয়া যায়। দড়াটানা মোড় থেকে গরীবশাহর মাজার পর্যন্ত গিয়ে দেখা যায় সাতটি ল্যাম্পপোস্ট থাকলেও সবগুলোই বিকল। আরেক পাশে ডিসি পার্কের আটটি লাইটের খাম্বা দেখা গেলেও অধিকাংশেরই লাইট নেই; যেগুলো রয়েছে সেগুলোও জ্বলে না। দড়াটানা থেকে মুজিব সড়ক হয়ে সিভিল কোর্ট পর্যন্ত পৌরসভার সব লাইট বিকল। একইভাবে শহরের মাইকপট্টি, লালদীঘিরপাড়, জজ কোর্ট মোড়েরও একই হাল চোখে পড়ে। শহরের প্রাণকেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, প্রাণকেন্দ্রটি শুধুমাত্র দুটি সার্চ লাইট আলোকিত রেখেছে, বাকি সব এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধুই শহরের প্রাণকেন্দ্র না, আশপাশের এলাকাগুলোরও একই অবস্থা। বিশেষ করে বারান্দীপাড়া, নাথপাড়া, জেল রোড, ঘোপ সেন্ট্রাল রোড, নওয়াপাড়া রোড, বেলতলা, পাইপপট্টি রোড, টিবি ক্লিনিক, বেজপাড়া, কাজীপাড়া, শংকরপুরের বিভিন্ন রোডে অধিকাংশ লাইটই নষ্ট। এসব বিষয়ে পৌরসভাকে বারবার অবহিত করলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
কাঠেরপুল এলাকার বাসিন্দা অপু বলেন, সন্ধ্যার পর থেকেই ওই এলাকায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিত্যদিনের ব্যাপার। চুরি-ছিনতাইসহ নানা অপরাধ ঘটে অহরহ। কিন্তু কোনো লাইট না থাকার কারণে এলাকা অপরাধীদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া ওই এলাকা দিয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে।
ঘোপের বাসিন্দা নান্টু জানান, ঘোপ কবরস্থান ও আশপাশে নেই একটিও লাইট। আশপাশ ঘিরে চলে মাদকের আড্ডা। ভয়ে নওয়াপাড়া রোড দিয়ে চলাচল করতে পারছেন না
বড়বাজারের ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম বলেন, শহরে প্রচণ্ড আকারে চুরি বেড়েছে। রাতে কোটি কোটি টাকার মালামাল ফেলে বাড়িতে যাই। পৌরসভাকে বারবার বললেও তারা কোনো কর্ণপাত করেন না। আল্লাহর ভরসায় থাকতে হয়।
এছাড়া জেল রোডের কাজল, গাড়িখানার সবুজ, ঘোপের আলামিন, মনিরুল, চৌরাস্তার ব্যবসায়ী জব্বার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এগুলো পৌরসভার লোকজনের গাফিলতি ছাড়া আর কিছুই না। লাইট সবই নষ্ট, এমনটি না, অনেক লাইটই ভালো রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ‘লুজ কানেকশন’ আছে। কিন্তু পৌরসভা থেকে কেউই এগুলোর দেখভাল করেন না। সম্প্রতি ঝড়-বাতাসের পর থেকে শহরের এ হাল হয়েছে বলে মন্তব্য করেন কেউ কেউ।
তারা আরও বলেন, প্রায় এক যুগ ধরে পৌরসভার বিদ্যুতের দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তারা অবহেলা করলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কোনো ভয় নেই, নেই জবাবদিহিতাও। রয়েছেন অনেকেই। তারা ‘লাইট নেই’ এই অজুহাতে হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। সমস্যার কথা জানালে উল্টো উগ্র ব্যবহার করেন।
এ বিষয়ে বিদ্যুতের দায়িত্বে থাকা ইঞ্জিনিয়ার সাইফুজ্জামান তুহিন ‘গ্রামের কাগজ’কে বলেন, শহরে ৯ হাজার লাইট রয়েছে; তার মধ্যে ৫ হাজার লাইট সচল রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। এছাড়া প্রাণকেন্দ্রে ৬শ’ লাইটের মধ্যে ৪শ’ লাইট ভালো রয়েছে বলেও দাবি করেন। যদিও সরেজমিনে তার কথার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি। তিনি আরও জানান, পর্যাপ্ত লাইট তাদের মজুদে নেই। কিছু লাইট এসেছে; তারা কাজ শুরু করেছেন।
এ বিষয়ে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক সার্কেল) আহসান হাবিব বলেন, লোকালয় আলোকিত থাকলে অপরাধ কমে আসে; অন্ধকার এলাকাগুলো সন্ত্রাসীদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়। যশোরের প্রাণকেন্দ্রসহ আশপাশের এলাকায় লাইট না থাকার কারণে জননিরাপত্তা দিতে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। এতে করে অপরাধের মাত্রা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। একই সঙ্গে সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এ বিষয়ে পৌর প্রশাসক রফিকুল হাসান ‘গ্রামের কাগজ’কে বলেন, কিছু জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। আগে লাইটগুলো সরবরাহ করা হতো ইচ্ছেমতো যার-তার কাছ থেকে; বর্তমানে টেন্ডারের মাধ্যমে এক ঠিকাদারের কাছ থেকে লাইট সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু তিনি সময়মতো লাইট সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে লাইটের সংকট দেখা দিয়েছে। তবে পৌর কর্মচারীদের গাফিলতিও রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দেন।
আরও পড়ুন: যশোরে ডিবি পরিচয়ে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গণধোলাই, দুইজন আটক