নিজস্ব প্রতিবেদক
ভৈরব নদ দখলমুক্তসহ পাঁচ দফা দাবি আদায়ে মহাসড়কে অবস্থানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটি। মঙ্গলবার দুপুরে সংবাদ সংগঠনের অস্থায়ী কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত দাবিসমূহ হলো, ভৈরব নদসহ সকল নদী অবৈধ দখলদার ও নদী সীমানার ভেতরের দখল উচ্ছেদ করতে হবে ; ভৈরবের ভেতর হাসপাতাল ক্লিনিকের বর্জ্য, বাড়ি-প্রতিষ্ঠানে পয়প্রনালী সংযোগ বন্ধ করা এবং বাজারের বর্জ্য, ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে; নদী তট আইন মেনে নদীর সীমানা উদ্ধার করতে হবে; নদের উপর সংকীর্ণ সেতু অপসরণ করে, বিআইডব্লিউটিএ’র অনুমোদিত ও নৌ-চলাচলের উপযোগী সেতু করতে হবে এবং অস্থায়ী সেতুসমূহ সংস্কার করতে হবে এবং যশোর সদরের কচুয়া ইউনিয়নের ১১ কিলোমিটার অবমুক্ত নদীর অংশকে অবৈধ দখলদার মুক্ত করে ইকোপার্ক ঘোষণা করতে হবে।
এই দাবি আদায়ের লক্ষে আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি প্রদান ; ২৪ সেপ্টেম্বরএলজিইডি দফতরে স্মারকলিপি প্রদান এবং অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে যশোর-ঢাকা মহাসড়কে অবস্থানের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটির অন্যতম নেতা জিল্লুর রহমান ভিটু। উপস্থিত ছিলেন, ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ, উপদেষ্টা তসলিম-উর-রহমান, নাজিমউদ্দিন, হাচিনুর রহমান, পৌর নাগরিক কমিটি যশোর জেলার আহ্বায়ক শওকত আলী খান, ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটির সদস্য আবু হাসান, শাহাজান আলী, অধ্যক্ষ ইসরারুল হক, পলাশ বিশ্বাস, সুকদেব বিশ্বাস, উজ্জ্বল বিশ্বাস প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ জানান, দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর ২৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভৈরব নদ খনন ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। যদিও নদী সম্পদ উদ্ধার নদী তট আইন মেনে সংস্কার না করা ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। খনন কাজে নদীকে খালে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এই সংস্কারের লক্ষ্য ছিল নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করা, নৌ-চলোচলের উপযোগী করা। এ প্রয়োজনে নদীর উপর অবস্থিত ৫৩টি সেতু বিআইডব্লিউটিএ নীতিমালা অনুযায়ী পুনঃনির্মাণ করা। সেক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শহরের নান্দনিকতার নামে দড়াটানা সেতুরপশ্চিম পাশে নদীগর্ভে একটিপার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নদী তট আইন মানা হয়নি। বরং এই নদী তট আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে যশোর শহরে ভৈরবের মধ্যে যারা অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছে তাদের বৈধতা দেওয়া হয়েছে। দুই পাশের হাসপাতাল ক্লিনিকের দূষিত বর্জ্য এবং বাড়ি-ঘরের পয়প্রনালীসব নদীর সাথে যুক্ত করে দিয়ে নদীর পানি দূষণ ও দুর্গন্ধময় করে তুলেছে। প্রবাহিত পানি মানুষের ব্যবহারের অনুপোযোগই শুধু নয়- ব্যাপক রোগ বালাই ছড়াচ্ছে। বাজারের বর্জ্য, নানা ধরনের মালামাল নদী গর্ভে ও তীরে ফেলে নদী ভরাট করা হচ্ছে। এসব দেখার কেউ নেই। জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিরব দর্শকের ভূমিকা মানুষের মাঝে প্রশ্ন- প্রশাসনের যোগসাজোস ছাড়া এরূপ অবৈধ কাজ চলতে পারে না।
নদী সংস্কারের পর যশোর শহর পর্যন্ত জোয়ার-ভাটা আসছিল এবং দাইতলা পর্যন্ত জোয়ারের যে উচ্চতা ছিল তাতে ছোট ছোট ট্রলার আসার বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এলজিইডি’র নদীর উপর অবৈধ হস্তক্ষেপ অপতৎপরতা পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। এবং তিনটি স্থানে সংকীর্ণ সেতু নির্মাণে নদী বেঁধে রাখার ফলে জোয়ার-ভাটার প্রবলতা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। পানি প্রবাহ সচল না থাকার কারণে কচুরিপানায় নদী আবদ্ধ হয়ে পড়ছে।
নেতৃবৃন্দ জানান, এলজিইডি নৌ-চলাচলের উপযোগী এবং বিআইডব্লিউটিএ’র অনুমোদন ছাড়া গায়ের জোরে নদী বেঁধে ছাতিয়ানতলা, দাইতলা এবং রাজারহাটে সংকীর্ণ সেতু নির্মাণ করার কার্যক্রম শুরু করে। যার ফলে জোয়ার-ভাটা প্রবল বাধাপ্রাপ্ত হয়। ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন এবং জনগণের পক্ষ থেকে বারবার নীতিমালা লঙ্ঘন করে সেতু নির্মাণে আপত্তি করা হলেও তারা সে কথা কর্ণপাত না করে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করে। আমরা বাধ্য হয়ে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হই। আদালত ২৭/১১/২৩ ইং তারিখে তিন মাসের মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ’র নীতিমালা অনুযায়ী সেতুর কাজ সম্পাদন করতে বলেন। ছয় মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তারা সে কাজ সম্পাদন না করলে আদালত ২৮/০৫/২৪ ইং তারিখে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে স্ব-শরীরে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। এলজিইডি’র চিফ ইঞ্জিনিয়ারের প্রতিনিধি ও যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ এলজিইডি কর্তৃপক্ষ আদালতে হাজির হয়ে ছয় মাসের মধ্যে নীতিমালা অনুযায়ী ব্রিজ নির্মাণ করে দেবেন মর্মে ১১/০৬/২৪ ইং তারিখে লিখিত প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ইতিমধ্যে চৌদ্দ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। তারা আদালতকে উপেক্ষা করে সঠিক নির্মাণ কাজ সম্পাদন বন্ধ করে রেখেছে।
নেতৃবৃন্দ উল্লেখ করেন, ভৈরব নদ সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণকালীন সময়ে আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উজানে মাথাভাঙা ভৈরব নদী সংযোগের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এই নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা গেলে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে পানি নদী ব্যবস্থাপনা পুনর্জাগরণ সম্ভব হবে। আর ভবদহের নদী মুক্তেশ্বরীর নি¤œ প্রবাহ। মুক্তেশ্বরীর প্রাণ ফিরে পাওয়ার সাথে ভবদহ, উপকূলীয় জলাবদ্ধতা, নদী রক্ষা, বিল হরিনা ও শহরের পানি নিষ্কাশনের সমস্যা সমাধান হবে।
কপোতাক্ষ নদ, আপার ভৈরব ও ভৈরব নদ সংস্কার সম্পন্ন হওয়ায়, দর্শনা থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার সংযোগ নিশ্চিত করলে আমরা পদ্মা-মাথাভাঙার নদী সংযোগ পাবো। আমরা দৃঢ়ভাবে আশা করি- এই সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে এই অঞ্চলের কোন নদী দখল, অবৈধ হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া যাবে না। আমরা উদ্বেগ ও ক্ষোভের সাথে লক্ষ্য করছি- মুক্তেশ্বরী নদীর উপর দখলদারদের আধিপত্য ও আদ-দ্বীন নামক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং মুক্তেশ্বরী ভরাট করে প্লট বিক্রয়ের সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। যা সরকারের গৃহীত ভবদহ সংস্কার প্রস্তাবসমূহ এবং উজানে নদী সংযোগের নীতিগত সিদ্ধান্ত পরিপন্থী। আমরা এই মুহূর্তে ভৈরব, কপোতাক্ষ, চিত্রা, মুক্তেশ্বরী, হরিহরসহ সকল নদ-নদীর অবৈধ দখলদার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
একইসাথে যশোর সদরের কচুয়া ইউনিয়নের কৈখালীতে ভৈরবে ১১ কিলোমিটার অংশে অবৈধ দখলদারেরা দখল করে ইচ্ছামতো ব্যবহার ও পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। উচ্চ আদালত ওই অংশ অবমুক্ত ঘোষণা করার পরও তারা আদালতের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে চলেছে এবং বছরের পর বছর জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও অদৃশ্য কারণে এ সম্পদ রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।