♦ ইসির তালিকায় যশোরের ৮ সংস্থার ৩টির হদিস নেই
♦ শর্ত লংঘন করে তালিকায় হিউম্যান রাইটস ভয়েজ
♦ সাইনবোর্ডে সীমাবদ্ধরা তালিকাভুক্ত হওয়ায় ক্ষোভ
জাহিদ হাসান
নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ইসির নিবন্ধন পেতে যাওয়া স্থানীয় পর্যবেক্ষণের তালিকায় যে ৬৮ সংস্থা রয়েছে তার মধ্যে যশোরের হিউম্যান রাইটস ভয়েজ একটি। শহরের কারবালা রোডস্থ এই সংস্থাটির নির্বাহী প্রধান এ কে এম নুরুল আমিন। তিনি জাতীয় পার্টির জেলা শাখার সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে নিযুক্ত হওয়ার শর্তবলীতে রয়েছে কোন রাজনৈতিক দলের পদপদবিধারী কোন ব্যক্তি জড়িত থাকলে সংস্থাটি নিবন্ধন বাতিল হবে। অথচ সংস্থাটির প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত থাকার পরেও পর্যবেক্ষণে ইসির তালিকায় স্থান পেয়েছে। যা নিয়ে জেলার সচেতন মহলের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি এই তালিকায় নাম থাকাতে পর্যবেক্ষণের তালিকাও নিয়ে হাস্যরসে পরিণত হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ভয়েজসহ এ জেলাতে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ইসির চূড়ান্ত নিবন্ধন পেতে যাওয়া তালিকাতে রয়েছে ৮টি সংস্থা। এর মধ্যে মণিরামপুর উপজেলার ডেভেলপমেন্ট পাটনার (ডিপি) ও সার্ভিসেস ফর ইকুয়িটি এন্ড ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্ট (সীড) সংস্থাটির কার্যক্রম সাইনবোর্ডে সীমাবদ্ধ আছে। তালিকায় নাম থাকলেও যশোর শহরের সমাজ উন্নয়ন প্রয়াসের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। দীর্ঘদিন এনজিও নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্টরাও সংস্থাটি সম্পর্কে কিছু বলতে পারেনি। আর সদরের বঞ্চিতা সমাজ কল্যাণ সংস্থা, বাঁচতে শেখা এবং কেশবপুর উপজেলার ‘এসো বাঁচতে শিখি’ ও প্রকাশ গণকেন্দ্র নামে এই চারটি সংগঠন তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন। নারী ও শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমাজ উন্নয়নে তারা কাজ করছেন।
সরেজমিন মণিরামপুরের সীডের কার্যালয়ে যাওয়া হয়। দিঘীরপাড় বাজারে অবস্থিত প্রধান কার্যালয়ে যেয়ে দেখা গেছে দপ্তরের বাইরে একটি ছেড়াকাটা সাইনবোর্ড। ১৫-১৬ বছর ধরে কার্যক্রম না চলায় সীডের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত টিনের চালার আধাপাকা জরাজীর্ণ ঘর পড়ে আছে। কার্যালয়ের চারপাশে জমে আছে ঝোপঝাড়। নির্বাচন কমিশনের তালিকায় স্থান পাওয়া নাজনীন ইসলাম নামে সীডের যে সভাপতির নাম দেওয়া আছে তিনি ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। তাকে দিঘীরপাড় অঞ্চলের কেউ চেনেন না। এছাড়া সীডের সাত সদস্যের পরিচালনা কমিটিতে যারা আছেন তারা নির্বাহী পরিচালক রেবেকা সুলতানার নিকট আত্মীয়-স্বজন। স্থানীয়রা বলছেন, ২৫-৩০ বছর আগে গ্রামে একটি সমিতি ছিল। সে সমিতি দুভাগ হয়ে যাওয়ায় আকবার হোসেন নামে এক সদস্য সীড এনজিওটি খোলেন। শুরুতে বেশ জমজমাট চলছিল। ১৫-১৬ বছর আগে আকবরের মৃত্যু হলে তার স্ত্রী রেবেকা সুলতানা এনজিও চালাতে শুরু করেন। আকবরের মৃত্যুর পর থেকে আর এনজিওটি চলেনি। এখন ১০-১২ বছর ধরে ভাঙা ঘর পড়ে আছে। আকবারের স্ত্রী ছেলে ঢাকায় থাকেন। জমি দখলে রাখার জন্য একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীডের বর্তমান সভাপতি নাজনীন ইসলামের ঢাকায় এনজিও আছে। সেখানে তার সাথে কাজ করেন রেবেকা সুলতানা। নিজেদের প্রতিষ্ঠান ধরে রাখতে নাজনীন ইসলামকে নামমাত্র সভাপতি বানিয়ে রেখেছেন রেবেকা সুলতানা। সীডের নির্বাহী পরিচালক রেবেকা সুলতানা এনজিও না চলার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর আর তেমন চালাতে পারিনি। এখন এনজিওর তেমন কোন কার্যক্রম নেই। আমরা এবার নতুন নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পাচ্ছি। আমাদের ক্ষতি করবেন না। এদিকে একই অবস্থা ডেভেলপমেন্ট পার্টনার (ডিপি) নামের এনজিওটির। মণিরামপুর পোস্ট অফিস পাড়ায় সাইনবোর্ড ঝুলানো এনজিওটির কার্যক্রম বহুদিন বন্ধ রয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, বহুদিন ধরে এ অফিস খোলে না। এখানে কাউকে আসতে দেখা যায় না। গতকাল এনজিওটির দপ্তরে গেলে দেখা গেছে ধুয়ে মুছে পরিস্কারের কাজ চলছে।
খোঁজ নিতে জানা গেল, সাংবাদিক আসার খবর আগে থেকে আঁচ করতে পেরে শ্রমিক দিয়ে দপ্তরে পরিচ্ছন্নতার কাজ করাচ্ছিলেন ডিপির নির্বাহী পরিচালক কানিজ শবনম শাপলা। ২৭ জন সাধারণ সদস্য ও ৯ সদস্যর নির্বাহী কমিটি রয়েছে এনজিওর। সংস্থার বর্তমান সভাপতি মোকাম্মেল হোসেনের বাড়ি উপজেলার কাশিমনগর ইউনিয়নে। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী হওয়ায় সংস্থার দিকে নজর দিতে পারেন না।
ডিপির নির্বাহী পরিচালন কানিজ শবনম বলেন, আমাদের নওগাঁ জেলায় ভিজিডির কাজ চলমান রয়েছে। মণিরামপুরে কার্যক্রম না থাকায় নিয়মিত অফিস খোলা হয় না। আমার বাবা মরহুম মতিয়ার রহমান এনজিওটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার স্মৃতি ধরে রাখতে আমি এনজিওর হাল ধরে আছি।
কেশবপুরের এসো বাঁচতে শিখি সংগঠনটি ১৯৯৩ সাল থেকে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আসাদুজ্জামান খান কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেই। দুই বার ইউনিয়ন সমন্বয়কারী ও ২ বার পর্যবেক্ষক হিসেবে আসাদুজ্জামানের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ১৭ জন জনবল রয়েছে। এলাকায় সমাজকল্যাণমূলক কাজ করে। বর্তমানে তেমন কোন কাজ নজরে আসেনি বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। তবে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে আউট অব স্কুল চিলড্রেন নামে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে ২০টি কেন্দ্রে কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আসাদুজ্জামান খান দাবি করেছেন। অপরদিকে ২০০২ সালে প্রকাশ গণকেন্দ্র কেশবপুর উপজেলার মঙ্গলকোটে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে কেশবপুর মেইন রোডের পুরাতন গরুহাটা এলাকার একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় ৭৭ জন জনবল কার্যাক্রম চালাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আ.স.ম আমানুল হাসান তাইমুর কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেই। তিনি পূর্বে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্পে কাজ করতেন। পূর্বে এ সংগঠন একবার পৌর ও একবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছে। বর্তমানে কেশবপুরে এ সংগঠনের কোন কার্যক্রম নেই। ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলায় আউট অব স্কুল চিলড্রেন নামে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে ৭০টি কেন্দ্রে কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে দাবি করেছেন প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ইউছুফ আলী।
এনজিওদের সংগঠন এডাব যশোরের সহ সভাপতি শাজাহান নান্নু বলেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ইসির তালিকায় ৬৮ যে সংস্থা রয়েছে তার মধ্যে ৮টি যশোরে। এর মধ্যে বাঁচতে শেখা আর বঞ্চিতা নামে দুটি সংস্থা সমাজ উন্নয়ন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে। বাকী সংস্থারগুলোর অফিস থাকলেও তাদের কার্যক্রমের অস্তিত্ব নেই।
জানতে চাইলে জেলা সিনিয়র নির্বাচন অফিসার আনিচুর রহমান বলেন, ইসি যে তালিকা করেছে সেটা আমাদের করা না। এসব সংস্থাগুলো ঢাকাতে সরাসরি আবেদন করে। ইসি দপ্তর যাচাই-বাছাই করে নির্বাচন পর্যবেক্ষকের তালিকা প্রকাশ করেছে। এ কাজে মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন অফিসগুলো সম্পৃক্ততা নেই।